আবহমান-৬। ক্রোড়পত্র- হায় রাম। সম্পাদনায় বেবী সাউ, মণিশংকর বিশ্বাস হিন্দোল ভট্টাচার্য

Saturday, May 5, 2018

ধারাবাহিক গদ্য: চন্দন ঘোষ





চিকিৎ-'শকিং' ডায়রি :  পাঁচু অথবা শ্লীলতাহানির কিস্যা


 কথায় বলে রতনে রতন চেনে। তা ভাটপাড়া হসপিটালে এসে সৌম্য এক রতন আবিষ্কার করেছিল। সে হল জিডিএ পাঁচু। সে ছিল উত্তর কলকাতার এককালের খানদানী গুণ্ডা। পাঁজা সাহেবের খাস আদমী। তার ডান গালে একটা কাটা দাগ অনেক কথা বলে দেয়। তার পায়ে অপোনেন্ট একবার দানা ভরে দিয়েছিল। তারপর থেকে সে রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে সাহেবের দয়ায় ভাটপাড়া হাসপাতালে জায়গা পেয়েছিল। তা পাঁচু সৌম্যর খুব ন্যাওটা হয়ে পড়েছিল। নাইট ডিউটিতে সে সৌম্যর জন্য ভাত আর ডিমের ঝোল রাঁধত। গলা অব্দি মাল খেয়ে টং কিন্তু একটু টসকাত না পাঁচু। সারারাত নিজেত বীরত্বের গল্প চলত। সে বলত, এখনকার মস্তান আর কিসের মস্তান। এরা তো মেয়েদের পর্যন্ত মান দেয় না স্যার। পিস্তল ধরলেই শের! ছোঁ! আমরা মেয়েদের দিকে কখনও কুনজরে তাকাইনি স্যার। ঠনঠনের মা কালীর দিব্যি।

তো এক রোববার এই পাঁচুর সঙ্গে মর্নিং ডিউটি করছে সৌম্য। সাড়ে নটা নাগাদ পাঁচু হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। বলে, সার আমাদের কংগ্রেসের একটা ডেপুটেশন দেবার কথা ছিল আজ সকাল দশটায়। তা সুপার তো লাপাত্তা। ওরা তো এল বলে। আপনিই ডেপুটেশনটা নিয়ে নিন, স্যার। সৌম্য তো আকাশ থেকে পড়ে। সে কি! আমি ই এম ও। আমি ডেপুটেশন নিতে যাব কেন? স্যার, ওদের হাসপাতাল নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। আপনি না সামলালে ভাঙচুর হয়ে যাবে, স্যার। তাছাড়া আমি ওদের কথা দিয়েছি। আপনার কিচ্ছু ক্ষতি হবে না স্যার। আমি সব ম্যানেজ করে নেব। আপনি না করবেন না, স্যার। অগত্যা ব্যাজার মুখে সুপারের ঘরে যেতে হল সৌম্যকে। পাঁচু সুপারের চেয়ারটা এগিয়ে দেয় যত্ন করে। সৌম্য কী যেন ভেবে বলে, না হে ওই চেয়ারে আমি বসব না। তুমি আমাকে বরং অন্য চেয়ার দাও।

ইতিমধ্যে হইহই করে একদল লোক পতাকাসহ ঘরে ঢুকে পড়ে। তাদের মুখে মুহুর্মুহু ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও গোছের  শ্লোগান। দলটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় এক ল-ইয়ার। বিস্তর চেঁচামেচির পর তারা বল্ল, এক্ষুনি সব দাবি মিটিয়ে দিতে হবে। কো-অর্ডিনেশনের জুলুমের বিরুদ্ধে অ্যাকশান নিতে হবে। সৌম্য বলে, দেখুন আমি তো সুপার নই, আমার সে পাওয়ারও নেই, তবে আমি আপনাদের দাবিদাওয়া সুপারের কাছে কালই পৌঁছে দেব। হঠাৎ ভীড়ের মধ্যে এক ছোকরা লাফিয়ে ওঠে। হাতে একটা আধলা ইট। আলবাত করতে হবে। আপনি সুপারের চেয়ারে বসে আছেন।  আপনাকেই করতে হবে। নইলে ভাঙচুর হবে। সুপারের নেমপ্লেট ভাঙব। সৌম্য অসহায়ের মতো পাঁচুকে খোঁজে। ও সামাল দেবে বলেছিল। কিন্তু পাঁচু ভাগলবা। হঠাৎ সৌম্য মাথায় ঝিলিক খেলে যায়। সে বলে, কই আমি তো সুপারের চেয়ারে নেই। এই তো দেখুন পাশের এই গদি আটা চেয়ার সুপারের। আমি আমার চেয়ারে বসে আছি ভাই। কথাটা শুনে উকিলবাবু মুচকি হেসে ফেলেন। তখন সাহস পেয়ে সৌম্য বলে, দেখুন সাহেব আপনি এদের সামলান, নইলে আরো বড়ো সমস্যার সৃষ্টি হবে। এক্ষুনি সরকারী দল চলে এল বলে। কী যেন চিন্তা করে ভদ্রলোক হাত তুলে সবাইকে থামালেন। বললেন, ডাক্তারবাবু যখন আশ্বাস দিচ্ছেন তখন আমরা মেমোরান্ডাম জমা দিয়ে আজকের মতো চলে যাচ্ছি। তবে কালই অ্যাকশান না নিলে ফের আসব। তারপর সবাই গদগদ হয়ে হাতে হাত মিলিয়ে থ্যানকু ট্যানকু বলে বিদায় নিল।

সৌম্যও হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তারপর সবে আরাম করে একটা ফিল্টার উইলস ধরিয়েছে কী ধরায়নি অমনি কোত্থেকে ভগ্নদূতের মতো হাঁপাতে হাঁপাতে পাঁচু এসে হাজির। স্যার স্যার সব্বোনাশ হয়েছে। কো-অর্ডিনেশনের লোকজন দল বেঁধে আসছে। এবার আপনি সামলান। আমি কাটলাম। 

দেখতে দেখতে কো-অর্ডিনেশনের লোকজন দল বেঁধে হাজির। দলটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুনীল সরকার। হাসপাতালের ক্লার্ক। মহা ঘাঘু মাল। সৌম্যর সঙ্গে তার এক প্রকার হৃদ্যতা আছে। কিন্তু সে দুধে আজ বোধহয় চিঁড়ে ভিজবে না। ওরা এসেই তারস্বরে বলতে শুরু করল, কংগ্রেসি তাণ্ডবে হাসপাতালের সম্পত্তি ভাঙচুর হয়েছে। এক্ষুনি এফ আই আর করতে হবে। সৌম্য জানে সব মিথ্যে। তবু বলে, কোন কোন সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে দেখান সুনীলবাবু। তখন সুনীল চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, শুধু সরকারি সম্পত্তি নষ্ট তো নয়, একজন নার্সের শ্লীলতাহানি হয়েছে, স্যার। এফ আই আর তো আপনাকে করতেই হবে। সৌম্য তো আকাশ থেকে পড়ে। তার মাথার চুল খাড়া খাড়া। তবু নিজেকে সংযত করে নিয়ে বলে, সে কী মশাই এ তো অতি গুরুতর অভিযোগ, এর তো একটা বিহিত করতেই হয়। তা ডাকুন সিস্টার দিদিমণিকে। ওর মুখ থেকেই শুনি ব্যাপারটা। ঘোড়েল সুনীল বলে, শুক্লাদি খুব ভেঙে পড়েছে স্যার। ওকে ডেকে আর কী হবে। আপনি বরং এফ আই আরের ব্যবস্থা করুন। সৌম্য বলে, উঁহু, তা তো হয় না সুনীলবাবু, ব্যাপারটা সরেজমিনে বুঝতে হবে। অগত্যা সিস্টারকে ডাকা হল। শুক্লা সিস্টার আসতেই সৌম্য বলে, সিস্টার অভিযোগ গুরুতর। এরা বলছে আপনার নাকি শ্লীলতাহানি হয়েছে। তা পুলিশকে বলার আগে আমাকে বলে ফেলুন ঠিক কী ব্যাপার ঘটেছিল। সিস্টার তো ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। বলে, না স্যার এরা আমাকে ফাঁসাচ্ছে। ওরা শুধু ওয়ার্ডে একটা কালো রামছাগল ঢুকিয়ে দিয়ে গ্যাছে। সেটা এখনো ওয়ার্ডে ব্যান্ডেজ চিবোচ্ছে। আমি আর কিছু জানি না স্যার। 

সৌম্য এবার সুনীলের দিকে তাকিয়ে বলে, কী সুনীলবাবু, এই আপনার শ্লীলতাহানি? এর জন্যে এফ আই আর-ও করতে হবে। আহা রে! এবার কি ছাগলটাকেও ডেকে পাঠাতে হবে নাকি। ওর যদি শ্লীলতাহানি হয়ে থাকে। কী বলেন,সুনীলবাবু? সুনীলবাবু মাথাফাতা চুলকে আমতা আমতা করতে থাকেন। ততক্ষণে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। সৌম্য সুনীলকে বলে, জানেন সুনীলবাবু, একে বলে টিপেছ, কী টিপেছি। গল্পটা আপনাকে আরেকদিন বলব কেমন? আজ চলি, কী বলেন?

(ক্রমশ)

No comments:

Post a Comment