আবহমান-৬। ক্রোড়পত্র- হায় রাম। সম্পাদনায় বেবী সাউ, মণিশংকর বিশ্বাস হিন্দোল ভট্টাচার্য

Saturday, May 5, 2018

রাম রামায়ণ ও রামরাজত্ব : রাজর্ষি দে



                              


              রাম রামায়ণ ও রামরাজত্ব


ব্যারাকপুরে আছি ২০০৪ থেকে‌ স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মের গায়েই রেলের জমিতে একটা পুরনো বটগাছ ছিল এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় যা হয়, একদিন দেখা গেল গাছের তলায় একটা পাথর মাটি ফুড়ে উঠেছে, তার গায়ে আবার খানিক গেরুয়া রং লেপা হনুমানজী প্রকট হলেন এরপর নিয়ম মাফিকই সব ঘটতে থাকল প্রথমে প্রণামীর থালা এল, তারপর ছোট বাঁধানো বেদী এল, তারপর ছোট ঘুপচি মন্দির হল, মন্দিরের কলেবর বেড়ে চললো, হনুমানজীর পাশে শিবজী, লোকনাথবাবা এরাও স্থান করে নিলেন, পেটমোটা পুরোহিত আর হেঁটমাথা ভক্তের ভিড় বেড়ে চললো, মন্দিরের আয়তন বেড়ে তিন চার কক্ষ হল, পাথর আর মার্বেলে মুড়ে গেল দেবালয়, আশেপাশে শিল্প গড়ে উঠল- প্রসাদ, ফুল, সিঁদুর ইত্যাদি, ইত্যাদি সকালে অফিস টাইমে ডাউন ট্রেনগুলো হাত নাড়তে নাড়তে দু নম্বর দিয়ে শিয়ালদহের দিকে রওনা দিত আমি আজন্ম আলস্য প্রিয়, ব্যারাকপুর লোকালে ফাঁকায় ফাঁকায় যাওয়ার লোভে দাঁড়িয়ে থাকতাম ১A প্লাটফর্মে বছর দুতিন আগে থেকে খেয়াল করলাম শিয়ালদহগামী নিত্যযাত্রীদের কেউ কেউ বেশ নিয়ম করে মন্দিরের পাশ দিয়ে ট্রেন বেরোনোর সময় হনুমানজীর নামে জয়ধ্বনি দিত যদিও ধর্মকর্ম সেই ছোটবেলা থেকেই ধাতে সয়না, তবু সাধারণ হিন্দু বাঙালি ঘরে জন্মানোর সুবাদে হাজার কিসিমের দেবদেবী আর ভগবানের সঙ্গে ভালই পরিচয় ছিল দুর্গাপুজোর শাসনহীন বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরা, লক্ষ্মীপুজোর নাড়ু, সরস্বতী পুজোর দৃষ্টিপাত এসব নিয়েই মানিয়ে গুছিয়ে চলেছে আমার নাস্তিক জীবন, কিন্তু হনুমানজীকে নিয়ে হিন্দু বাঙালির মাথাব্যথা কোনোদিন নজরে পড়েনি হনুমানজীর নামে জয়ধ্বনির সঙ্গে বছরখানেক আগে জুড়লো “জয় শ্রীরাম” আশ্চর্য হয়ে দেখলাম ভক্তির বদলে বেশিরভাগ সময়েই ভক্তের মুখেচোখে ফুটে উঠছে এক হিংস্র আনন্দ
রামের সঙ্গে আমার পরিচয় সেই ছোট্টবেলায় প্রথম কোথায় শুনেছিলাম রামের কথা সত্যি বলতে কি আর মনে নেই প্রথম পড়েছিলাম “ছবিতে রামায়ণ” বইতে এর পরে আরো বেশ কিছু জায়গায় খাপছাড়া ভাবে পড়েছি তবে এখানেই বলে নেওয়া ভাল বাল্মীকি রামায়ণ, তুলসিদাসের রামচরিতমানস বা কৃত্তিবাসী রামায়ণ কোনটাই পড়া হয়ে ওঠেনি, কৃত্তিবাস হয়তো কিছুটা পড়েছিলাম তাই কারোর যদি মনে হয় কিছু না জেনেই লিখতে বসেছি তাহলে বান্দা নাচার! আসলে মহাকাব্য বইয়ের পাতায় যতটা না থাকে, তার থেকেও বেশি থাকে মানুষের স্মৃতিতে মুখে মুখে ফেরা কাহিনীতে মানুষ নিজেদের খুঁজতে থাকে আর সেই খোঁজার পথে বারবার করে গল্প বদলে বদলে যায় কোথাও রাম আদর্শ পুত্র, কোথাও রাম রাজত্বের হাতছানি, কোথাও কাপুরুষ ও প্রবঞ্চক, আবার কোথাও বা নারীবিদ্বেষী মেল-শভিনিস্ট-পিগ এই প্রতিটা দেখাই সত্যি, কিন্তু কোনটিই একমাত্র সত্য নয় এই যে বহু সত্যের সহাবস্থান, এর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে যে কোনো মহাকাব্যের প্রাণভোমরা, সে রামায়ণ হোক বা মহাভারত, ইলিয়াড হোক বা অডিসি
কিন্তু বর্তমানে যে রামের ধ্বজা উড়ছে ভারতবর্ষে, সে একমাত্রিক যেই রাজনীতিতে সব ভারতবাসীর ধর্ম হিন্দু, ভাষা হিন্দি, খাদ্য নিরামিষ আর মাতা গরু, সেই রাজনীতিতেই রামচন্দ্র আজ এক “ঐতিহাসিক চরিত্র” যে ইতিহাসে পুষ্পক বিমানে চেপে সনাতন ভারতীয়রা যাতায়াত করত, প্লাস্টিক সার্জারী করে গণেশের গলায় হাতির মুণ্ডু বসানো হয়েছিল, ইন্টারনেটে মহাভারত যুদ্ধের লাইভ টেলিকাস্ট দেখতেন ধৃতরাষ্ট্র, সেই ইতিহাসেই রাম জন্ম নিয়েছিলেন অযোধ্যায়- যেই স্থানে বাবরি মসজিদ ছিল একদম সেই জায়গাতেই! কাল্পনিক অতীতের গৌরবগাঁথা আবিষ্কারের এই প্রচেষ্টা, পৌরাণিক চরিত্রদের একমাত্রিক প্রবল শক্তিমান সামরিক নায়ক হিসেবে তুলে ধরা, ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রকে ক্রমাগত মিশিয়ে দেওয়া- খেয়াল করে দেখলে ফ্যাসিজমের চিহ্নগুলো দিনদিন সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে এর সঙ্গে যদি মিলিয়ে দেখি অকস্মাৎ বাংলায় অস্ত্র হাতে রামনবমী পালনের হিড়িক, পুরো খাপে খাপ মিলে যাবে প্রবল ক্ষত্রিয় যোদ্ধা রামচন্দ্র কোনদিনই বাংলায় পূজিত ছিল না বাংলার রাম কৃত্তিবাসের রাম- “সীতা ধ্যান, সীতা জ্ঞান, সীতা চিন্তামণি। সীতা বিনা আমি যেন মণিহারা ফণী।। কিন্তু নানা কিসিমের বানরদলের দাপাদাপিতে বাংলার রাম তার নিজের চরিত্র হারিযে ফেলে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের “মূলস্রোতের” গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে গেছে
এই দেশে একবার রামজন্মভূমি আন্দোলনের নামে রামরথ চলেছিল সেই রথের চাকার তলায় ভারতবর্ষের আত্মা সেই যে চাপা পড়ে গেছিল, আর বোধহয় মুক্তি পায়নি আমাদেব্র মতন ধর্মভীরু গুরুবাদী সমাজে প্রথম থেকেই নানা পৌরাণিক চরিত্রের মাহাত্ম্য ছিলই দূরদর্শনে যখন প্রথমে রামানন্দ সাগর রামায়ণ দেখানো শুরু করলেন তখন অনেকেই নাকি সিরিয়াল শুরু হওয়ার আগে টিভি সেটটিকে ফুল-মালা দিয়ে পুজো করতেন কিন্তু সেই সহজ সরল বিশ্বাসের সঙ্গেই এক সহজাত পরিমিতি বোধ ছিল মানুষের রাস্তা ঘাটে হনুমান দেখলে মানুষ হয়তো কপালে হাত ঠেকাতেন, কিন্তু সাধারণত এইরম দাবি কেউ করতেন না যে ধৃতরাষ্ট্র টিভিতে মহাভারত যুদ্ধের লাইভ টেলিকাস্ট দেখতেন অন্তত সেইরম যারা ভাবত তদের সমাজের মূলস্রোত মনে করা হত না কিন্তু আজ উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় মৌলবাদের ব্যাকরণে রামের প্রতীককে সামনে রেখে দেশে বিষবাস্প ভরা হচ্ছে আর আমার পাশের অনেক মানুষ যেন কেমন অচেনা হয়ে উঠছেন একজন ধর্ষিতা বাচ্চা মেয়ের আর্ত চিৎকার ঢেকে দেওয়া যাচ্ছে “জয় শ্রীরাম” ধ্বনি দিয়ে দেশে প্রকৃত অর্থেই রামরাজত্ব গড়ে উঠছে


No comments:

Post a Comment