আবহমান-৬। ক্রোড়পত্র- হায় রাম। সম্পাদনায় বেবী সাউ, মণিশংকর বিশ্বাস হিন্দোল ভট্টাচার্য

Saturday, May 5, 2018

আমাদের রাম ব্যক্তিগত : বেবী সাউ





              আমাদের রাম ব্যক্তিগত

অন্ধকার এসে বসে আমাদের উঠোনের মাঝে--- আর আমরা পাঁচজন কাঁপতে কাঁপতে সন্ধেতারার কাছে চাইতে বসতাম, রোদের গল্প। লাল টিপ পরে ঠাকুমা একে একে সমস্ত ঘরে আলো দেখাচ্ছেন। "যা... যা... অন্ধকার যা..."--- ঠাকুমার ধোয়া শাড়ির গন্ধে, আমরাও সুর মেলাতাম। অনেকটা কমে যেত অন্ধকার, ভয়। ধুনোর গন্ধে ভরে উঠত আমাদের শিউলি তলা; সন্ধের আওয়াজ। আমরা পাঁচজন, খুড়তুতো জেঠতুতো ছেলে মেয়ে প্লাস আমি, ভাইবোন মিলে অপেক্ষা করতাম ঠাকুরকে  প্রদীপ দেখানো কখন শেষ হয়। ততক্ষণে হাত পা ধুয়ে বসে পড়তাম মাদুরের ওপর। উপুড় হয়ে প্রণাম সারছেন ঠাকুমা। আলতা পা দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে জ্বলেজ্বলে প্রদীপের শিখা। আমাদের উৎসুকতা বাড়ছে। লাল পেড়ে গরদের শাড়ি, ধুনোর গন্ধ মেখে ঠাকুমা এসে বসতেন আমাদের সবার মাঝে। আজ সেই সরযূ নদী পেরোনোর দিন। ছোট রাম। আমাদের রাম। ঠাকুমা আমার দিকে আঙুল তুলে  বললেন --"ঠিক, তোর মতো বয়েস।" আমার বুক গর্বে ফুলে উঠল বেশ কয়েক ইঞ্চি। ভাই বোনেরা আমার দিকে ছুঁড়ল ঈর্ষার দৃষ্টি। আরে বাবা, আমার এতে কী দোষ! কেউ যদি আমার মতো হয়,  তবে কী তার দায়ভার আমার! যাকগে, ঠাকুমার এইটুকু কথাতেই, রামের আসন পাকা। আমিও সত্যি সত্যি রাম। সরযূ নদীর জলে ছলছল করছে আমার পায়ের শব্দ। ভাই যেহেতু সবদিন আমার সব কথার অবাধ্যতা করে, তাই বোনকে সাজালাম লক্ষ্মণের বেশে। আর আমাদের বিশু বাবু হলেন রাগী বিশ্বামিত্র। এই বিশুবাবু সত্যিই সত্যিই মূর্তিমান বিশ্বামিত্র। মনে আছে, যখন আমি পড়তে চাইতাম না, মায়ের শাসনের সুর ছিল, "এবার থেকে তোকে বিশুবাবুর কাছে পড়তে পাঠাতে হবে।" বিশুবাবুর ফিজ ছিল তিনশো টাকা, তখনকার সবচেয়ে দামি টিউশান টিচার। আর বন্ধুমুখে শুনেছি, তাঁর দয়ামায়া কোনও মনুষ্য সন্তানের প্রতি ছিল না, যতটা ছিল অঙ্কের প্রতি। অঙ্ক কষতে না পারলে তিনি যেকোন প্রাণীর ছাল ছুলে নিতে এক মুহূর্ত ভাবতেন না। যাইহোক, বিশুবাবু ওরফে বিশ্বামিত্র মুনির সঙ্গে আমরা দুই বোন, রাম আর লক্ষ্মণ, চলেছি সেই গভীর অরণ্যে। সমস্ত ঝাড়গ্রামবাসী এগিয়ে এসেছে পায়ে পায়ে। কান্নায় ভরে আছে তাদের চোখ। মন। মায়ের চোখেও জল। ঠিক কৌশল্যার মতো, বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। অথচ, আমরা দুই বোন নির্ভীক, হাঁটছি আর হাঁটছি। কাঁদছিও। মনে মনে ভাবছি, তাড়কা রাক্ষসী আসলে ঠিক কতটা লম্বা? সন্ধ্যাপিসির মতো? কতটা কালো? আমাদের তালগাছটির গুড়ির মতো? ভাবতে ভাবতে চলেছি। বিশুবাবু আরও গম্ভীর। বোঝাচ্ছেন কতটা তাক করতে পারলে একটা হত্যা সহজ হয়ে উঠবে! কতটুকু ভয় মেশাতে পারলে একটা চিৎকার হয়ে উঠবে রাজার আদেশ! ধনুকের ছিলায় মেশাতে হবে ঠিক কী পরিমাণ এ প্লাস বি এর স্কোয়ার! যদিও, তাঁর কাছে আমার সমস্ত বীরত্ব গোপন করে গেছি। উনি নিশ্চয়ই জানেন না, আমি মেয়ে হতে পারি, কিন্তু কোনও অংশে রামের কম নই। আমার পোষা নোটন পায়রার বাচ্চার দিকে তাকিয়েছিল বলে, জেঠিমার হুলোকে বস্তা বন্দী করা ব্যক্তিটি আমিই। আমিই প্রথম যে ভোর বেলা তালতলা থেকে কুড়িয়ে আনতে পারি পাকা তাল। ভাইয়েরা, বোনেরা করে দেখাক এমনসব বীরত্বের পর্ব কখনও! তবেই মানবো রাম হওয়ার যোগ্যতা আছে তাদের!

তো, রাম চলেছেন বনবাসে। চোদ্দ ইনটু তিনশো পঁয়ষট্টি। রাজা দশরথ বিলাপ করছেন। অথচ, বিশ্বামিত্রের অভিশাপ তো হেলাফেলার নয়। তখন ছিল ব্রহ্মতেজ। এখন যেমন হয়েছে ফেসবুকে ব্লক। বাবাও যত আমাকে হোস্টেলে পাঠানোর কথা বলুন না কেন-- নিশ্চয়ই এরকম বিলাপ করবেন। নিশ্চয়ই ভাববেন, মেয়েটিকে কোল ছাড়া করা যাবে না কিছুতেই। আমি রাম, এতসব ভাবছি আর হাঁটছি। ধীরে ধীরে। মনখারাপ লাগছে খুব। মায়ের জন্য, ভাইয়ের জন্য, পায়রাগুলির জন্য। তখনই ঠাকুমা চুপ। প্রণাম করে বন্ধ করলেন লাল মলাটের পাতা। আমরা ভাইবোনেরা অপেক্ষা করলাম পরের দিনের। অঙ্ক কষতে  কষতে ভাবলাম, বিশুবাবুকে ক্ষেপানো যাবে না কিছুতেই; যদি আমাকে না, ভাইকেই রাম সাজিয়ে নিয়ে যান সেই অরণ্যের পথে! তখন তো ফেলুদা নেই, যে সমস্ত কূটচাল উন্মুক্ত করে দিতে পারেন নিমেষে। নাকি শার্লক হোমস! দাদুর কাছ থেকে জেনে নিতে এই লোকটির ঠিকানা। ভাইয়ের সমস্ত ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিতে হবে একবার। যদিও, ওই একবার ছাড়া ঠাকুমা কখনও আমাকে আর বলেননি কিন্তু সেদিন থেকে প্রতিটি সন্ধেতে আমি রাম হয়ে উঠতাম। কখনও জ্যোৎস্নার আলোয় ভাসত, ইয়া বড় রাক্ষসীর ছায়া; টগবগে দুপুরে যখন মা ঘুমাত, কলতলার কাছে তাকিয়ে ধূ ধূ শিবানন্দপুরের মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখতাম, টগবগে রোদে হেঁটে যাচ্ছে সোনার হরিণ। পেছনে পেছনে ছুটছে আমাদের নরদাদার ছেলে বুল্টা। তখন মনে হত ওই রাম। ওর কাছে বাঁশের কঞ্চির তীর আছে, দড়ি দিয়ে বানানো ধনুষ আছে। আর আছে মুখে সুর তুলতে পারার ক্ষমতা। কত যে পাখিকে ডেকে আনে এই সুরে! কখনও বাঁশি, কখনও কোকিল কখনও ঘুঘুডাক। রাম হওয়ার যোগ্য ব্যক্তি বটে। কিন্তু কিছুতেই ও আমাকে পাত্তা দিত না। কী আর করা যাবে! তার ভেতরে যে সম্ভাবনাটুকু দেখতে পাচ্ছিলাল, মাঠেই মারা গেল! 

   ধীরে ধীরে সীতা চলেছেন বনবাসে। খোলা পিঠ ভর্তি চুল। কোঁকড়ানো। সুন্দর দেখতে, ঠিক বোনের মত। বোনই সীতা। সীতাই বোন। মুখে তার বিষাদের মেঘ। ঠিক, বহুদিন পরে যেমন, বোনকে হোস্টেলে পাঠানো কালে হয়েছিল। এতবড় একটা ট্রাঙ্ক। বোন যাচ্ছে বনবাসে। পথে সাপ, বাঘ, মৃত শেয়ালের চোখ। এতসব পেরিয়ে সীতাকে যেতে হবে। আমি তার বাহক, লক্ষ্মণ। গাড়ি চালাচ্ছি। রাম তখন অন্যকেউ। রাম তখন খুব খারাপ। কেউ এভাবে মিথ্যেমিথ্যি সুন্দরকে নির্বাসন দিতে পারে নাহলে? আমি কাঁদছি, ভাইবোনেরা কাঁদছে। মা রুটি বানাতে বানাতে সব শুনছেন। চোখ মুছছেন। ঠাকুমা আরও করুণ। জেঠিমা বিষাদ মেখে চায়ের কাপ নিয়ে গেলেন সদরের ঘরে। দাদুর চা-পানের সময় এটি। ঠাকুমা আজ সব ভুলে ছোট্ট সীতা-টি। সেদিন আমাদের ঘর শোকস্তব্ধ। আমাদের বাগানে কোনও ফুল ফুটেনি সেদিন। রাতে ঘুমের ঘোরে আমি রামকে বন্দি করছি--- ওই হুলো বেড়ালটিকে যেভাবে করেছিলাম। লব-কুশ যেভাবে করেছিল। ছোট পিসিমনি সেদিনই বলে উঠেছিলেন, এই জন্যই বলি মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়াটা জরুরী বেশি। সীতার যদি তাই হত তবে রামের এত স্পর্ধা হতই না নির্বাসনে পাঠানোর। 

   ধীরে ধীরে সময় পেরোয়। আমাদের 'শ্রীরাম পাঁচালী' শেষ হয়। আমরা বড় হয়ে উঠি। ঠাকুমা ধরেছেন মহাভারত। শ্রীকৃষ্ণ। অর্জুন। কর্ণ। বেচারা কর্ণ! তার বহুদিন আগে, রাম রাম খেলা ছেড়ে জেঠু ঢুকে যাচ্ছেন নকশাল আন্দোলনে। তখন আমরা কেউ নেই। দাদু থাকেন বাইরে। ঠাকুমা অসহায়। ছেলেকে ফেরাতে হবে। দুপুর বেলা। হিমালয় থেকে ভগবান নেমে আসেন। হাত দেখে বলেন, বিপ্লব আসবে তোদের ঘরে! জড়সড় ঠাকুমা সন্ন্যাসী কে চিঁড়ে, মুড়ি, ঘরে পাতা দই খাওয়ান। রামকৃষ্ণের কথামৃত মানার চেষ্টা করেন। জেঠু ঘুমিয়ে থাকলে, চুপিচুপি মাথায় ছোঁয়ান পচা জবাফুল-- কালীর আশীর্বাদ। অথচ, অবস্থান পাল্টায় না। বাবা আর কাকু হোস্টেলে। বড়পিসিমনির বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট পিসিমনি ম্যাট্রিক। তখন থেকে ঠাকুমার পুজোর ঘর। ভয় থেকে জন্মালেন রাম, শ্রীকৃষ্ণ, কালী, দুর্গা। জেঠু এসব মুছে দিতে চান, ঠাকুমা তত জড়িয়ে ধরেন এদের। অসহায় রাম পড়েছেন ফাঁদে চিৎকার করে বলছেন---
" আত্মানং মানুষং মন্যে রামং দশরথাত্মজম্‌... " 

   আর রামের প্রকৃত পিতা বাল্মীকি অপেক্ষা করছেন একটা নোবেলের, আনন্দ পুরস্কারের মায় একটা বইতরণী পুরস্কার হলেও চলে...একটা রৌপ্য পদক; যাকে পরবর্তী কালে অনুবাদ করবেন কৃত্তিবাস--- ঠাকুমার মতো করে!


11 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ আপনাকে। ভালোলাগা।

      Delete
    2. কি ভালো কি ভালো।
      আমাদের ছোটবেলায় এমন সব গল্প শুনতে শুনতে নিজেরাই হয়ে উঠতাম চরিত্রের পাত্র
      খুউব ভাল লাগলো

      Delete
  2. অবশেষে বইতরণী! আমারও ভয় করছে। বেবীর লেখার স্বাতন্ত্র অনুচিন্তন দেখে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভাবছিলাম রেগেই প্রথমে আমাকে ব্লক করবেন 😉। যাক বাঁচা গেল

      Delete
  3. অসামান্য। রামের এই নির্মাণ বিনির্মাণ আমাদের রক্তে লেগে থাক। লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  4. অসাধারণ।

    ReplyDelete
  5. অন্যের আরাধ্যকে নিয়ে এসব লেখা কেবল খা/ঙ্কিরছেলেমেয়েদের পক্ষেই সম্ভব। খুব সুন্দর হয়েছে খা/ঙ্কিরমেয়ে। আরেক চাওয়া ছিল মোহাম্মদকে নিয়ে এরকম একটা লেখা চাই।

    ReplyDelete
  6. ভাল লেখা

    ReplyDelete
  7. যারা তোমাকে গালি দিচ্ছে তারা মূর্খ। হয়তো বাল্মীকির নামই শোনেনি। পড়া তো দূরস্তান। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে 'বালি বধ' পর্বটি ফেসবুকে পোস্ট দিই। বিজয়োৎসবে কি কী পদ পরিবেশিত হয়েছিল বাল্মীকি রামায়ণে সবিস্তারে লেখা আছে।

    ReplyDelete