আবহমান-৬। ক্রোড়পত্র- হায় রাম। সম্পাদনায় বেবী সাউ, মণিশংকর বিশ্বাস হিন্দোল ভট্টাচার্য

Saturday, May 5, 2018

রামায়ণ বনাম রাম : হিন্দোল ভট্টাচার্য



             রামায়ণ বনাম রাম

যে কোনও সাহিত্যের চরিত্র যখন আমরা পড়ি বা তার জীবনের ঘটনার মধ্যে যখন আমরা ডুবে যাই, আমাদের মনে এমনকী কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের স্বপ্নের মধ্যেও তার জীবনের চতুর্দিক একটা জলজ্যান্ত ছবির মতো তৈরি হয়ে যায়। আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি সেই বাস্তবতাটিকে। আবার আমাদের মনের মধ্যে এই সচেতনতাও থাকে, যে পঠিত বা দেখা সেই বাস্তবতাটি প্রকৃত বাস্তবতা নয়, যদিও বাস্তবতার খুব কাছাকাছি। মানে, এমন বাস্তব আমরা তৈরি করে নিতেই পারি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তো, সাহিত্যের বা শিল্পের বাস্তব, প্রকৃত বাস্তবের চেয়েও আরও কঠিন, আরও সমালোচনামূলক, আরও ব্যঙ্গাত্মক এবং আরও তীক্ষ্ণ হয়। যেমন, যদি ধরি, কাফকার মেটামরফোসিস-এর কে এর বাস্তব, যে ঘুম ভেঙে দেখে সে একটা পোকা হয়ে গেছে। আবার দস্তয়ভস্কির রাসকলনিকভ-এর কথাও ভাবা যায়। কে অস্বীকার করবে তাকে? কে অস্বীকার করবে জয়েসের স্টিফেন ডেডেলাসকে, লিওপোল্ড ব্লম, মলি ব্লুমকে? এমন অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায় বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যগুলি থেকে, যেগুলির মুখ্য চরিত্র আমাদের যাপনে মিশে গেছে, প্রাত্যহিকতার ভাবনায় মিশে গেছে, আমাদের এই জীবনের দিকে তাকিয়ে জীবনকে দেখার আঙ্গিকেও মিশে গেছে। সত্যি কথা বলতে কী স্টিফেন ডেডেলাস বা কাফকার কে বা রাসকলনিকভ বা পাভেল ভ্লাসভ যদি আমাদের জীবনের আরাধ্য দেবতা হত, তাহলে সেই সব সাহিত্য হয়তো এতদিন বাঁচত না। কারণ সেই সব সাহিত্যের কোথাও এই সব চরিত্রগুলির অমরত্বের কথা ভাবা হয়নি। বরং আমাদের প্রচলিত ভাবনাগুলিকেই আক্রমণ করা হয়েছে এমনভাবে, যাতে, সেই সব চরিত্রগুলির সাথে আমরা প্রতিনিয়ত ডায়ালগে নামি, নিজের নিজের মতো করে প্রতিনিয়ত পাঠ তৈরি করি সেই সব চরিত্রের। কে-এর বা মার্সেলো-র  বা রাসকলনিকভের বহুস্তরীয় পাঠ যাতে বেরিয়ে আসে, যাতে আরও নানান অর্থে সেই সব চরিত্রগুলির সাথে আমাদের আরেকটু বোঝাপড়া হয়।
কেউ যখন দেবীত্ব বা দেবত্ব প্রাপ্ত হয়, তখন তার নিজস্ব রক্তমাংস, নিজস্ব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মানবিক অস্তিত্বটি আর থাকে না। অথচ কোনও সাহিত্যিকেরই মনে হয় সেই উদ্দেশ্যটি থাকে না, যে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রটি হয়ে উঠুক মানবিক চাওয়া-পাওয়া-না পাওয়া- খারাপ- ভালো-র ঊর্ধে এক অবতার স্বরূপ। আমার ধারণা, সেই চরিত্রগুলি যদি মহাকাব্যেরও হয়, তাহলেও সেই মহাকাব্যের রচয়িতা বা রচয়িতারা কখনওই চান নি তাঁর লিখিত চরিত্রগুলিকে অবতার রূপে পাথরের মূর্তিতে পরিণত করতে। রাম যখন সীতাকে পাতাল প্রবেশ করতে কার্যত বাধ্য করেন, বা বালিকে হত্যা করেন, বা লক্ষ্মণ যখন নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ইন্দ্রজিতকে হত্যা করেন নিরস্ত্র অবস্থায়, বা শেষের দিকে যখন রাম তীব্র মনস্তাপে ভোগেন, তখন মনে হয় রাম এক দেবতা নন, মানুষ। তখন 'মনে হয়, তিনি যদি মানবিক ‘ফিগার’ না হয়ে দেবতা হতেন, তাহলে কী আর বাল্মীকি এভাবে রচনা করতেন তাঁকে? একই রকম এবং আরও বেশিরকম ভাবে ব্যাসদেব মহাভারতে কোনও চরিত্রকেই কলঙ্কমুক্ত রাখেন নি। এমনকী যে কৃষ্ণকে আমরা আরেক অবতার হিসেবে পুজো করি, সেই কৃষ্ণের হাজার ত্রুটি। এবং সেই কৃষ্ণ যে কখনওই সততার পরাকাষ্ঠা নয়, তাও বুঝি।  মহাভারতেও কেউ দেবতা নয়, মানুষ, লোভে, পাপে হিংসায়, প্রেমে, অপ্রেমে, কামনায়, ধর্মে, অধর্মে, যুদ্ধে, শোকে, সন্তাপে মানুষ। তারা মারেন, তারা অনুশোচনায় ভোগেন, শাস্তি পান সময়ের নিয়মে, এও বলেন যে, যে কাজ তাঁরা করেছেন, তার শাস্তি তাঁদের পেতে হবে ইহজীবনেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। সমগ্র মহাভারত জুড়েই যেন অন্ধকার আর আলোর খেলা। কিন্তু কেউ সেখানে প্রচুর আলো বা প্রচুর অন্ধকার হয়ে নেই।
মুশকিলটা তাহলে কোথায়? রামায়ণ বা মহাভারত পরবর্তীকালে যারা পাঠ করে, যারা তাতে অসংখ্য বিষয় যুক্ত করে এই দুই মহান সাহিত্যকে ধর্মের সাথে এক করে দিলেন, তখন হলো বিপর্যয়। আমরা তো দেখেছি এই দুই মহাকাব্যেই প্রতীক এবং রূপকার্থের ছড়াছড়ি। কখনও কখনও এও মনে হয়, ভারতবর্ষের প্রাচীন টেক্সট মানেই রূপকার্থ। একদিকে গল্প  চলছে, আর একদিকে দর্শন। একদিকে একটা সহজ স্টোরিলাইন, আর ভিতরে চলছে জটিল দর্শনের খেলা। সেই সহজ স্টোরিলাইনের মধ্যেও যে আছে অসংখ্য কূট প্রশ্ন, তাও বোঝা যায়। আসল কাজ তো সেই কূটপ্রশ্নগুলি ধরে সহজের দিকে যাওয়া। কিন্তু কখনওই সহজ স্টোরিলাইনকে ইতিহাস ভাবা নয়।
একটা মত যেমন আছে এই যে, যেহেতু চরিত্রগুলি অনেকটাই হিউম্যান বা মানবিক, তাই প্রায় ৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বের এই সব বিষয় নিয়ে লিখিত টেক্সটে চরিত্রগুলি মানবিক হয়ে যায় তখনই , যখন তার মধ্যে সামান্য হলেও ঐতিহাসিক উপাদান থাকে। এর অর্থ, রাম সম্পর্কে বাল্মীকি যখন সাদা-কালো চরিত্রকে উপস্থাপনা করেন, তখন বলা যায় রাম বাস্তবিক ছিলেন। কিন্তু উল্টোদিকে এটি কি বাল্মীকির বা সেই সময়ের সাহিত্যের সংবেদনশীল সাবালকত্ব হিসেবেও আমরা ধরতে পারি না? অ-মানবিক বা ডি-হিউম্যানাইজ করলে বরং সেগুলি অনেক বেশি অবাস্তব হয়ে যেত। তার মানে বাল্মীকি সেই সব করেননি বলেই ধরে নিতে হবে, যেমন করেননি ব্যাসদেব। আমাদের পুরাণগুলি তুলনামূলক ভাবে কম প্রাচীন এবং সেখানে ক্ষমতা তথা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাব থাকায়, সেই টেক্সটগুলিতে বরং শিব, বিষ্ণু ইত্যাদি চরিত্রকে কেবল দেবতা হিসেবেই আমরা আবিষ্কার করি, যদিও প্রচুর রূপকার্থ এবং প্রতীকে সেই সব টেক্সট ভর্তি।
কিন্তু আমাদের আলোচ্য বিষয় অন্য। আলোচ্য বিষয় হল, রাম যদি সাহিত্যিক চরিত্র হবে, তবে তা ঐতিহাসিক কীভাবে হয়? সাহিত্য অবশ্যই ঐতিহাসিক উপাদান। সাহিত্যের মাধ্যমেই আমরা পেয়ে যাই একটা বিশেষ সময়ের সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চিত্র। প্রথমত, আমরা রামায়ণের আনুমানিক সময়কাল ধরে সে সময়ের ভারতবর্ষকেই ভিশুয়ালাইজ করতে পারি না। যেটি দেখি, তা হল, মিথের বা সাহিত্যের এক বিশেষ ‘পাঠ’-এর আধুনিক রূপান্তর। আমরা বানিয়ে নিচ্ছি একটি সত্যকে। বানিয়ে নিচ্ছি একটি না-ইতিহাস-কে ইতিহাসে। আর এই বানিয়ে নেওয়ার পিছনে কাজ করছে দীর্ঘকালের ক্ষমতাতন্ত্র। ধর্মকে বা গণসংস্কৃতিকে যারা ক্ষমতার ‘যন্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করেছে। সবকিছুর  মতো দেবতার দেবত্বের জন্য-ও এক বিশেষ শ্রেণির মানুষের ( ক্ষমতাতন্ত্রের) বিশেষ ধরনের প্রচারের প্রয়োজনীয়তা থাকে। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র সেই প্রচারক, যা আর্য-সংস্কৃতি বা ক্ষমতা-সংস্কৃতিকে জনমানসে ছড়িয়ে দিলেন। আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্রের বহু আগে, তাঁরা আবিষ্কার করেছিলেন  প্রচারের অনবদ্য কৌশল এবং সত্য নির্মাণের রাস্তাগুলি। এই ক্ষমতায় থাকা, বা ক্ষমতাকে নির্ধারণ করা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে যখন সাহিত্য পড়ে গেল, তখন সেই সাহিত্যের চরিত্রগুলির মধ্যে দেবত্ব আরোপিত এবং প্রচারিতও হল। এই প্রচারের কৌশলে অন্যতম কষ্টিপাথর ছিল অবতার রূপ। সাহিত্য, মিথ, কবিতা, শ্রুতি এবং ব্রাহ্মণ্যবাদীদের/ ক্ষমতাতন্ত্রীদের প্রচার এবং ধর্ম রূপে প্রতিষ্ঠা করার সত্যটিই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রচারিত হতে শুরু করলো। না হলে, যার কোনও ইতিহাস নেই, সেই ইতিহাস কখনও তৈরি হয়? শুধু তৈরি হল তাই নয়, সেই ইতিহাস হয়ে উঠল ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে ধার্মিক অনুশাসনের অংশ। রাম-সীতা-হনুমানের সামগ্রিক কাল্টের মধ্যে যে আর্য-ক্ষমতাতন্ত্রের প্রমাণ, তা অন্য কিছুতে নেই। এভাবেই এখানে সাহিত্য থেকে মিথ এবং মিথ থেকে ইতিহাস তৈরি হয়েছে। এবং যারা সেই ইতিহাস তৈরি করেছে তাদের মতে ইতিহাস থেকে সাহিত্য এবং সাহিত্য থেকে মিথ তৈরি হয়েছে।
সাহিত্যই তবে যদি হয় রামের জন্মভূমি, তবে অযোধ্যা কীভাবে হবে তার ঐতিহাসিক সূচনালগ্ন? হতে পারে, সাহিত্যের পাতায় অযোধ্যার এই জন্মভূমি হয়ে ওঠার কথা লিখিত আছে । কিন্তু তাতে প্রমাণ হয় না যে ভৌগোলিক অযোধ্যাই রামের জন্মভূমি। রাম সম্পর্কিত কোনওকিছুর তাই ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। সাহিত্যিক ভিত্তি আছে। আর সাহিত্য থেকেই সেই সব তথ্য ঢুকে গেছে মিথে এবং তার পরে ইতিহাসে।
রামায়ণের অস্তিত্ব নিয়ে তাই সংশয় না জাগলেও যে রাম পূজিত হন, যে রামকে লক্ষ্য করে / শিখণ্ডী করে কিছু মানুষের ধর্ম ও কর্মসংস্থান চলে, যে রামের যুদ্ধযাত্রাকে মনে রাখতে অস্ত্র হাতে মিছিল করা হয়, যে রামের জন্য কয়েক হাজার মানুষ একে অপরকে হত্যা করেন, তা আদপেই যে নির্মিত ইতিহাস এবং কিছু ক্ষমতাতন্ত্রী মানুষের বহুবছরের নির্মাণ, প্রচার এবং রাজনীতির অংশ, তিনি আদৌ বাল্মীকি লিখিত ‘রাম’ নন। বাল্মীকি-লিখিত রাম তো কেবল ও কেবলমাত্র রামায়ণে আছেন। তাহলে এই যে ফিকশনাল রাম একটা গোটা জনজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের উন্মত্ত করে তোলে, তাদের কাছে এই সম্ভাবনা  আর এই উল্টোসত্যিকে কীভাবে নিয়ে যাওয়া যাবে, সেটিই প্রশ্ন।
একদিকে কয়েকহাজার বছরের নির্মিত সত্য এবং মিথ আর আরেকদিকে কয়েকহাজার বছরের সাহিত্য- আসল দ্বন্দ্ব কি এখানে লাগছে না? কারণ সাহিত্যকে গৌণ করে সাহিত্য থেকে জাত/ নির্মিত মিথ / ইতিহাসকে প্রধান করলে সাহিত্য ( যা আসলে সত্য) আঘাতপ্রাপ্ত হয়। রামকে দেবতা বানালে আদতে রামায়ণের সাহিত্য/ রামায়ণের রচয়িতার ক্ষমতাকে খাটো করা হয়, সে বিষয়েও তো কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা কি আদৌ রামায়ণ নামক সাহিত্যটিকে মর্যাদা দিতে চাইছি না আমাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসকে, যা বহু বছর ধরে তৈরি করা হয়েছে এবং বর্তমানে যাকে ব্যবহার করছে একটি ফ্যাসিস্ট শক্তি। আর হয়ত সে কারণেই এই ফ্যাসিস্ট শক্তি রামায়ণের কিছু অংশ এডিট করার কথাও ভাবছেন। তাতে ভারতবর্ষের রামভক্তদের-ই তো গর্জে ওঠার কথা। কিন্তু তাঁরা গর্জাচ্ছেন না। কারণ সাহিত্য নিয়ে তাঁরা ভাবিত নন। সাহিত্য থেকে দীর্ঘকাল ধরে যে মিথ-কে তৈরি করা হয়েছে, প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তাকে ব্যবহার করতেই তাঁরা বেশি আগ্রহী।
সাহিত্য বনাম রাজনৈতিক ‘মিথ’ – এই অসম যুদ্ধে সাহিত্যের যে মৃত্যু হবে, তার অশনি সংকেত তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।

4 comments:

  1. লামা লামা।

    ReplyDelete
  2. জরুরি লেখা। রাম চরিত্রটির বহুতর পাঠ ধরা পড়েছে লেখাটায়। ভাল লাগল।

    ReplyDelete
  3. লেখা নিয়ে বলার কিছু নেই। খুবই ভালো হয়েছে। কিন্তু ভাবছিলাম, চোরা নাহি শুনে ধর্মের কাহিনি! আর সেই না-শোনার চর্চা যখন এক গণ-সম্মোহনের চেহারা নিয়েছে, তার সামনে আমাদের এইসব তৃণাঞ্জলির গতি কী হবে?

    ReplyDelete
  4. আমাদের পুরাণ নিয়ে, ইতিহাসবোধ নিয়ে এমন লেখা হিন্দোলের পক্ষেই সম্ভব । এই লেখার কাছে আমাদের নতজানু হতে হবেই !

    ReplyDelete