সুখেন মুর্মুর চদরবদর
সকাল সকাল উত্তর দিনাজপুর থেকে রওনা দিয়ে প্রায় বিকেল পার হয়ে মেলায় পৌঁছেছে সুখেন। পথ তো কম নয়। জায়গাটার নাম ক্রান্তি। পুজোর পরই এই মেলাটায় আসার জন্য হাঁকপাঁক করে সুখেন। কয়েকবছর হলো মেলাগুলো সব অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। যখন বাবার সঙ্গে সঙ্গে আসত, বাবা সারিন্দাটা বাজাতেই চারদিকে ভিড় জমে যেত। এখন মাইক বাজিয়ে তারস্বরে গান-বাজনা হয়। ভাওয়াইয়ার সুর শোনা যায় সেই ধরলার পার থেকে। চার চারখানা গাড়ি বদলিয়ে আসার ধকল অবশ্য মুহূর্তে মিলিয়ে যায় ধরলা পার হতে হতে।
ভাওয়াইয়া গানের বিরামের ফাঁকে ফাঁকে সুখেনকে শুরু করতে হয় আখ্যান। যেমন মেলা, তেমনি কথন, সব মেলায় কী আর এক কথন চলে! এইখানে এলে চেকেন্দা ভাণ্ডারির গল্পটা শোনায় আগে। কথন তো সেই একই, কথনের গুনে জানা গল্প অচেনা করে ফেলতে হয়। না হলে আবার কথোয়াল কীসের! সারিন্দাটা কাঁধের সঙ্গে আটকে এক হাতে বাজানোর অভ্যেস করতে হয়েছে সুখেনেকে ছোটবেলা থেকে। সুখেন একে গীতাল, গান করে। তার ওপর কথোয়াল, গল্প বলে। তার ওপর আবার খেলোয়ার, পুতুল খেলায়। তার ওপর নাচোয়ালও, নিজে নাচেও। এক হাতে সারিন্দাটা থাকে, অন্য হাতে একটি পুতুল নাচের তক্তা। সেটা চৌকো একটা ছোটখাটো স্টেজের মতো। মাথায় কাপড়ের ছাউনি। স্টেজটাও কাপড়ে ঢাকা। তার তলায় থাকে সুখেনের আরেকটা হাত।
মেলায় এসেই একটা ভাঁজ-করা তেপায়া পাটাতন পেতে ফেলে সুখেন। তার ওপর বসায় সেই ছোট স্টেজ। স্টেজের ভিতর সাতখানা পুতুল সুখেনের হাতের ইশারায় তার গল্পের সঙ্গে নাচবে। কিন্তু সবার ওপর একটি বারে সমানে নাচ দেখিয়ে যাচ্ছে একটি আরো বড় পুতুল। অনেকটা সার্কাসের ট্রাপিজের খেলা দেখানোর মতো। সুখেন জানে, ওর বাজানো সারিন্দা আর ওই পুতুলটার খেলা, এই দুটোই লোককে দূর থেকে টেনে আনবে।
মাইকের ভাওয়াইয়া গান কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেলে আস্তে আস্তে লোক জড়ো হতে থাকে। সুখেন তখন গল্প বলা শুরু করে। যে-অঞ্চলে যায় সেখানকার গল্প। শুনেন শুনেন ভাই-বোন-দাদা-দিদিরা-বৌদিরা শুনেন। এই যে হরাভরা জমি জিরাত দেখিতেসেন, এইগুলা কিছুই ছিল না আগত। এইখানে ছিল শুধু চেকেন্দার ঝোপ। মানে ভ্যারেণ্ডা। চাইরোপাখে শুধু চেকেন্দা আর চেকেন্দা। ধান নাই, পাট নাই, কিস্যু হয় না। এইদিকে তো দুগগা ঠাকুর শহর থিকা পূজা নিয়া, দশমীর দিন নালের অম্বল আর পান্তা খাইয়া কৈলাস যাবার ধরিসে। যাবি তো যা এই আস্তাই ধরিল। আর যায় ক্যানে! এইখানে সগায় ঘিরা ধরিসে, ক্যেমনে যাতি পারেন কৈলাস হামরালাও দেখি। মোদের জমিতে ধান-পাট ফলাইয়া তারপর যাও ক্যানে। দুগগা তো পড়িল মহা ফ্যাসাদে। তখন কহিল দুগগামাতা, মুই কী করিম –
বেটিছাওয়া মানষি মুই
না পারি চাষ-বাস।
যাতি দাও মোক ঘরত
যাতি দাও কৈলাস...
সুখেন গান ধরে দুর্গার হয়ে। তার পুতুলনাচের প্ল্যাটফরমের তলায় থাকে একটা হাত। প্রত্যেকটা পুতুলের হাত-পায়ের সঙ্গে বাঁধা পাতলা সুতো একটা লাঠির সঙ্গে বাঁধা। সেটা চাদরের তলা দিয়ে নাড়ায়। যেমন দুর্গা যখন হাত পা নেড়ে কাকুতি মিনতি জানাচ্ছে, পাশে তার চার ছেলেমেয়েও নড়ছে। দুর্গার উল্টোদিকে দাঁড়ানো আদিবাসী সাজের মানুষগুলোও তাদের হাত পা নাড়াচ্ছে নানা ভঙ্গিতে।
সুখেন আবার গল্প শুরু করে। মাঝখানে পুতুলের পাটাতনটাকে রেখে সারিন্দা বাজিয়ে আরেক বার চারদদিকে পাক খেয়ে নেচে নেয়। তারপর সুর টেনে বলে – তখন! তখন গেরামের লুক কয় কী! কী কহেন! তারা কী কহিতে পারে! কহেন! তারা কহিল –
যাতি না দিব দেবী
বন্দি করিলাম
এলায় মোরাও দেখি নিব
কৈলাস ক্যেমনে যান!
চারিদিকে ধুধু খরা
খাবার নাই ঘরত
চারিদিকে নাই নাই
লাগি গেসে মরক
দেবী তখন দেখিল ইমারা তো কিছুতেই তাকে কৈলাসে যাতি দিবে না। এলায় দশমীর দিনত বিসর্জন হয়া গেসে। তা বাদে বেবাক পূজা শ্যাষ। একাদশী থাকি দেবী এইখানে বিরাজ করল। ভাবিল কয়টা দিন এইখানে থাকি, এদের জমি জিরাতের বেবস্থা কইরা তারপর কৈলাসে ফিরিবেন। দেবী এ্যালা কী করেন! বেটিছাওয়া মানষির কৃষিকাজ করা তো ভালো দেখায় না। তখন দেবী দুগগা মালকোঁচা মাইরা ধুতি পরলেন। তার মোচও গজায় গেল। তিনি হইলেন পুরুষ। চার ছাওয়াল কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী নিয়া পুরুষবেশে পূজা নিলেন। এই দেশের ভাণ্ডার ভরি দিলেন। তাই দেবতার নাম হইল ভাণ্ডারী। সারিন্দাটা নিয়ে আবার ঘুরে ঘুরে নাচে সুখেন মুর্মু –
যাওনের আগত কহিল মাতা
তুমরায় কে কেমনে
আছ কুনখানে
বছর বছর আসিবক মুই
দেখিবার তানে।
জোড়া কবুতর উড়ায় দিলে
মুই বুঝিবার পাং
মোর লাগিয়া তুমরার মনত
করসে উচাটং
সেই থেকে ভাণ্ডারী দেবতাকে জ্যান্ত কবুতর দিয়া মানসিক করা হয়। যা যা মানসিক আসে, সব পুরা করে ভাণ্ডারী ঠাকুর। চারিদিকে কবুতরগুলান উড়িয়া বেড়ায়। আর ভাণ্ডারী ঠাকুরের আশির্বাদ উড়িয়া বেড়ায় গো…
গো... বলেই বেশ কায়দা করে আখ্যান শেষ করে, সুখেন মুর্মু। খুব দরদ দিয়ে আখ্যানটা বলে। এটা ওর বাবার কাছে শেখা। কিন্তু লোকজনের মুখ দেখে মনে হয় না আখ্যানটা তাদের পছন্দ হয়েছে। টাকা তো দূর, খুচরো পয়সাও পড়ে গোনাগুনতি।
কয়েকজন রসিক লোক হই হই করে ওঠে। আরে ঝিঞ্চ্যাক কিছু শোনাও না! মন ভরল নাই। ভালো কিছু শোনাও। সুখেন জানে, এইরকমই হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। খুব দরদ দিয়ে গাওয়া আখ্যানও কেউ পছন্দ করছে না। তাও সুখেন গায়, গেয়ে তৃপ্তি পায়। আবার লোকজনের অনুরোধে চটুল গানও শোনাতে হয়। দুর্গা ঠাকুরের আখ্যানের পুতুলগুলোকে বদলে অন্য পুতুল নিতে হয় তখন।
এই মুহূর্তে সুখেন চটজলদি সেসব কিছুই করে না। ওপরের পুতুলটা ট্রাপিজের খেলা শুধু দেখাতে থাকে। নিজের তৈরি সারিন্দাটা নিয়ে গান শোনাতে শোনাতে নিজেই নাচতে থাকে। বেদের মেয়ে জোৎস্না আমায় ফাঁকি দিয়েছে...
২
এই মেলায় তিনদিন থাকার কথা। দেশ-পাড়াগাঁর এই সব মেলাগুলো রাতেই জমে ওঠে। সারাদিনের চাষবাস, ঘর গেরস্থালি সামলে মেয়ে-পুরুষ সব্বাই মিলে সারারাত মেলায় হুল্লোড় করে যায়। রাত বিরেতে আবার মহিলারা ঘিরে ধরে ঠাকুরের পালাই শুনতে চায়। তখন মেলাগুলোতে আয়পত্তর হয় ভালোই। টাকা ছাড়াও কেউ কেউ চাল আলু দিয়ে যায়।
নাগরদোলার চাকা ঘুরতেই থাকে, ঢাকাই পরোটা আর জিলিপি দিয়ে দিয়ে কূল পায় না দোকানি। রাতে রান্না বসায় মেলায় সওদা-করতে-আসা দোকানিরা। একত্রে খাওয়া দাওয়া। মেলার মধ্যে অন্যান্য দোকানের সাথে অস্থায়ী দোকান পেতে বসে, মাছ-মাংসওয়ালারা। সেটা মেলারই অঙ্গ।
সুখেনের বউ একটা চাকি-বেলনির কথা বলছে অনেকদিন ধরে। আগেরটা খয়ে গেছে একেবারে। সুখেন একটা বেছে রাখে বিভূতির দোকান থেকে। আলাদা করে রেখে দিতে বলে। শেষ দিন নেবে। এইসব দোকানিরা প্রত্যেকেই সুখেনের চেনা। সব মেলায় না হলেও, কোনো না কোনো মেলায় দেখা হয়ে যায়। এই মেলা সেরে বিভূতিরা যাবে মৌলানির মেলায়।
সুখেনও ভাবে যাবে কী যাবে না। সবটাই নির্ভর করে আয়পত্তরের ওপর। কয়েকদিনের খাওয়া-পরার মতো টাকা জমে গেলে সুখেন বাডিতেই চলে যায়। নিজের মতো করে নতুন নতুন পালা বাঁধে। সেই পালা অনুয়ায়ী পুতুল তৈরি করে। কাঠ, বাঁশ দড়ি, কাপড় আর রঙ দিয়ে তৈরি করা আট-নয় ইঞ্চির পুতুলগুলো অবিকল রক্ত মাংসের মানুষের মতো দেখতে হয়ে যায়।
সুখেনের বেশির ভাগ পুতুলই আদিবাসীদের মতো দেখতে। তাদের পুরুষদের মাথায় পালক গোঁজা। রঙ কালো। মেয়েদের মাথায় ফুল। একদম নিখুঁত। তাদের পঞ্চায়েত বসে। বিচার হয়। সেইসব পালা আবার এখানে খাটে না। সেইসব পুতুল নিয়ে সুখেন যাবে এরপর হয়তো মৌলানি হয়ে মহিষবাথানে। মহিষবাথানে গেলে আদিবাসীদের পালা ধরবে। সে-পালাও মুখস্থ সুখেন মুর্মুর।
চেকেন্দার মেলার শেষদিন থেকে ঝেঁপে বৃষ্টি নামলে, শেষ পর্যন্ত মৌলানির মেলা ঘুরে যাওয়াই মনস্থ করে সুখেন। সার্কাসের লোকেরাও তাঁবু গোটানো শুরু করবে এবার। চেকেন্দা থেকে ক্রান্তি অব্দি গাড়ি পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ে। এই বৃষ্টির মধ্যে সামনেটা ঝাপসা হয়ে উঠেছে। বিকেল বিকেলই নেমে পড়েছে ঘন অন্ধকার। দূর থেকে একটা বাসকে আসতে দেখে হাত দেখায় সুখেন। সঙ্গে লটবহর তো কম না! কোনো রকমে মাথা গুঁজে নিচু বাসটায় উঠে পড়ে। বাসটা এতই নিচু যে ঘাড় থেকে মাথা গোঁজ করে দাঁড়াতে হয় সুখেনকে। হাতের জিনিসপত্তর কোনো রকমে রাখতে পারে ড্রাইভারের পায়ের কাছটায়। ছোট্ট বেঁটে বাসটার ছাদ ফুটো হয়ে জল পড়ছে ঝরঝর করে। সিট খুলে এগিয়ে আসছে সমানে। আপাদমস্তক ভিজে যেতে যেতেও সঙ্গের ট্রাঙ্কটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে সুখেন।
৩
সেদিন মৌলানির মেলায় পৌঁছলেও একদিনের বেশি থাকা হয় না সুখেনের। বৃষ্টিতে ভিজে গা-টা বেশ গরম গরম ঠেকে। সঙ্গে সর্দি, গলা ব্যথা। গলাটাই বড় যত্নে বাঁচিয়ে রাখতে হয় সুখেনকে। তাই পরদিনই পাত্তাড়ি গোটায় সেখান থেকে।
মহিষবাথানের মেলাটা বরং বড় মেলা। সেটা বাসার থেকে অনেকটা কাছেই। মহিষবাথানের মেলায় যাওয়ার আগে বাসায় কদিন বিশ্রাম নিয়ে গলাটা সারিয়ে নেবে, ভাবে সুখেন। বাসায় পৌঁছতে না পৌঁছতে বউটা, জিনিসপত্তর গুছিয়ে ওঠাবে কোথায়, তা নয় হাউমাউ শুরু করল। বিডিও অফিস থেকে নাকি খুঁজে গেছে সুখেন মুর্মুকে। বউ ভয় পেয়ে গেছে। বাড়ি ফিরতে মুখের জলটুকুও পর্যন্ত দিল না। রওনা করে দিল বিডিও অফিসের দিকে।
আলপথ দিয়ে হেঁটে গেলে ঘুরপথ হয়। তাই সরাসরি ক্ষেতের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি দ্রুত হেঁটে যাবে ভেবেছিল সুখেন। ধানগাছের গোড়াগুলো পথের কাঁটা। দরকারের সময় সবকিছুতেই দেরি হয়ে যায়। সোজাটা সোজাভাবে কিছুতেই হয় না, এইটা এক্কেবারে ঠিক কথা। ধানের গোড়াগুলোয় কয়েকবার ঠোক্কর খেয়ে মাথাটা নিজের ওপরই গরম হয়ে যায়।
বিডিও অফিস থেকে ডাক পাঠিয়েছে, শুনে অব্দি পেটের ভিতর গুড়গুড় করছে। তখন ঘরে ছিল না সে। থাকলে, বিডিও অফিসের চাপরাসির কাছে শুনে নিতে পারত কী বৃত্তান্ত। বউটা কিছুই জিগায় নাই। উলটা ভয় পায়ে হাউ মাউ করিবার ধরিসে। মনের মধ্যে একটা ভয় যে সুখেনেরও কাজ করছে না, তা নয়। হাজার হোক বিডিও অফিস ডেকে পাঠিয়েছে, কিছু কারণ তো আছেই। আশেপাশের কাউকে ডাকল না, ওকেই ডাকল। তাই নিয়ে বউটা প্যাচাল পারতেসে। সুখেন বারবার বুঝায় পুলিশে ডাকে নাই রে। বিডিও ছাহেব ডাকি পাঠায়সে!
বউএর কাছে, বিডিও অফিস আর পুলিশ সব সমান।
মনে মনে একটা গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে মাঠ পেরয় সুখেন। চিন্তার মুহূর্তে গান করা স্বভাব সুখেনের। বউটা যখন গাল পেড়ে সুখেনের গুষ্টি উদ্ধার করে, সুখেন তখন কোনো একটা গানের কলি ভাঁজতে থাকে গুনগুন করে। তাতে আরও তেলে বেগুনে জ্বলে যায় বউ। কিন্তু কিছু করার নেই। সুখেনের স্বভাবই এমন। গুনগুন করতে করতে নিজেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলে। সেখানে আর কেউ প্রবেশ করতে পারে না।
মাঠপথ ছেড়ে ইটের রাস্তা। রাস্তার পাশে মিউনিসিপালিটির কলে জল পড়ে যাচ্ছে ছ্যাড় ছ্যাড় করে। আশেপাশে জল নিতে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। কলটা বন্ধ করে দেয় সুখেন। তারপর এই জল পড়ে যাওয়া নিয়েই একটা গানের কলি ঢুকে যায় মগজে। গুনগুন করতে করতে সুরটা কথা খুঁজে ফেরে। ‘জলই জীবন আরে জলই জীবন, কল খুইলা রাখি দিয়া ডাকি এলায় মরণ ’!
ইটের পথটা পার হয়ে পাকা রাস্তায় খানিকটা যাওয়ার পর ছড়ানো ছিটানো ছোট ছোট ঘর নিয়ে বিডিও অফিসটা চোখে পড়ে। নতুন বিডিও আসার পর বেশ ফুলের বাগান টাগান দিয়ে সাজিয়েছে সামনেটা। এটুকু আসতে আসতেই বুকে হাঁপ ধরে যায় সুখেন মুর্মুর। এমনিতেই বড়মানুষদের সামনে গেলে নিশ্বাস দ্রুত হয়ে আসে তার। তার ওপর এতটা হেঁটে আসা।
অফিসের চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়ে দিশা পায় না সুরেন। এতগুলা ঘরের মইধ্যে কুনটা যে বিডিও ছাহেবের! পুরনো দিনের টিনের চাল দেওয়া ঘরগুলোর লম্বা বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারে খানিকক্ষণ। এত নিস্তব্ধ হয় কোনো অফিস, জানা ছিল না সুখেনের। ও কোর্টের পাশ দিয়ে গেছে, সেখানে হইহই করছে ভিড়। এদিক পানেও এসেছে অনেকবার, বাইরের রাস্তা দিয়ে চলে গেছে সোজা।
বারান্দায় চটিজোড়া খুলে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা একটা স্পর্শ পায়। বাইরে বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটার ড্রাইভারটাকে দেখতে পায় খইনি ডলছে। বিডিও ছাহেব আছে! কুন ঘরে যাব! ড্রাইভার হাতের ইশারায় বাঁদিকের একটা ঘর দেখিয়ে দিয়ে আবার খইনি ডলতে থাকে। তার আধবোজা চোখ যেন তাকিয়েও দেখে না সুখেনের দিকে।
ঘন নীল পর্দাটা ভীষণ ভারী ভারী লাগে সুখেনের। পর্দা ঠেলে মুখটা শুধু বের করে সে,
মনে মনে একটা গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে মাঠ পেরয় সুখেন। চিন্তার মুহূর্তে গান করা স্বভাব সুখেনের। বউটা যখন গাল পেড়ে সুখেনের গুষ্টি উদ্ধার করে, সুখেন তখন কোনো একটা গানের কলি ভাঁজতে থাকে গুনগুন করে। তাতে আরও তেলে বেগুনে জ্বলে যায় বউ। কিন্তু কিছু করার নেই। সুখেনের স্বভাবই এমন। গুনগুন করতে করতে নিজেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলে। সেখানে আর কেউ প্রবেশ করতে পারে না।
মাঠপথ ছেড়ে ইটের রাস্তা। রাস্তার পাশে মিউনিসিপালিটির কলে জল পড়ে যাচ্ছে ছ্যাড় ছ্যাড় করে। আশেপাশে জল নিতে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। কলটা বন্ধ করে দেয় সুখেন। তারপর এই জল পড়ে যাওয়া নিয়েই একটা গানের কলি ঢুকে যায় মগজে। গুনগুন করতে করতে সুরটা কথা খুঁজে ফেরে। ‘জলই জীবন আরে জলই জীবন, কল খুইলা রাখি দিয়া ডাকি এলায় মরণ ’!
ইটের পথটা পার হয়ে পাকা রাস্তায় খানিকটা যাওয়ার পর ছড়ানো ছিটানো ছোট ছোট ঘর নিয়ে বিডিও অফিসটা চোখে পড়ে। নতুন বিডিও আসার পর বেশ ফুলের বাগান টাগান দিয়ে সাজিয়েছে সামনেটা। এটুকু আসতে আসতেই বুকে হাঁপ ধরে যায় সুখেন মুর্মুর। এমনিতেই বড়মানুষদের সামনে গেলে নিশ্বাস দ্রুত হয়ে আসে তার। তার ওপর এতটা হেঁটে আসা।
অফিসের চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়ে দিশা পায় না সুরেন। এতগুলা ঘরের মইধ্যে কুনটা যে বিডিও ছাহেবের! পুরনো দিনের টিনের চাল দেওয়া ঘরগুলোর লম্বা বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারে খানিকক্ষণ। এত নিস্তব্ধ হয় কোনো অফিস, জানা ছিল না সুখেনের। ও কোর্টের পাশ দিয়ে গেছে, সেখানে হইহই করছে ভিড়। এদিক পানেও এসেছে অনেকবার, বাইরের রাস্তা দিয়ে চলে গেছে সোজা।
বারান্দায় চটিজোড়া খুলে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা একটা স্পর্শ পায়। বাইরে বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটার ড্রাইভারটাকে দেখতে পায় খইনি ডলছে। বিডিও ছাহেব আছে! কুন ঘরে যাব! ড্রাইভার হাতের ইশারায় বাঁদিকের একটা ঘর দেখিয়ে দিয়ে আবার খইনি ডলতে থাকে। তার আধবোজা চোখ যেন তাকিয়েও দেখে না সুখেনের দিকে।
ঘন নীল পর্দাটা ভীষণ ভারী ভারী লাগে সুখেনের। পর্দা ঠেলে মুখটা শুধু বের করে সে,
-ছ্যার!
-কি ব্যাপার!
মুখে কিশোরের মতো পেলবতা মাখানো একটি যুবক, যেন জোর করে গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করছে। বিডিও সাহেবের হাতে একটা ফাইল। তিনি মন দিয়ে ফাইলটায় কী যেন দেখছেন। স্যারের চেহারাটা দেখে বুকের থেকে অনেকটা ভার নেমে যায় সুখেনের। স্যারের উলটো দিকে বসে একজন বেশ পোড়খাওয়া চেহারার ভদ্রলোক। এই লোকটিকে চেনা চেনা ঠেকে সুখেনের। লোকটার চেহারাটা কেমন যেন খেকুরে মতো। তিনিও প্রায় একসঙ্গেই বলে ওঠেন,
- কী চাই!
- আজ্ঞে, মুই সুখেন মুর্মু। মোর বাসায় লোক গেছিল মোক ডাকিবার তানে।
নড়েচড়ে বসেন বিডিও সাহেব।
-ও আপনিই শিল্পী সুখেন মুর্মু, বসুন।
সামনের খালি চেয়ারটা হাত দিয়ে দেখিয়ে দেন তিনি। বিডিওর মুখে শিল্পী কথাটা শুনে টানটান হয়ে যায় সুখেনের বুক। শরীরের যেন অনেক বল এসে যায় মুহূর্তেই। শিল্পী সুখেন মুর্মুর সমস্ত শিল্পীসত্তাটাও যেন নড়েচড়ে বসে। সে যে শিল্পী, বাড়িতে থাকলে সেটা আর মনে থাকে না। পাড়া প্রতিবেশী থেকে ঘরের বউ, কেউ মানে না ওর শিল্পীসত্তাটাকে। শুধু যখন নিজের তৈরি সারিন্দাটা হাতে নেয়, সুর তোলে চোখ বন্ধ করে, সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায়। অন্য এক জগতে তখন সুখেন মুর্মুই রাজা।
সুখেন অপেক্ষা করে। ওর জগতে যেন কোনো কৌতূহল নেই, কোনো জিজ্ঞাসা নেই, তাড়াও নেই। বিডিও সাহেব কী বলবে তার অপেক্ষা করে থাকে। হাতের ফাইলটা খেকুরেকে দিয়ে বিডিও সাহেব সুখেনের দিকে তাকায়। খেকুরে যেন উঠব উঠব করেও ওঠে না।
-এখানে আসার পরই আপনার কথা শুনেছি, আপনি তো পুতুলনাচ দেখান, তাই না!
-আজ্ঞে হ্যাঁ। তয় এই পুতুলনাচ অইন্য। ইটারে কয় চদরবদর।
খেকুরে খ্যাক খ্যাক করে হেসে ওঠে,
- কী কয়? চুদুরবুদুর!
-না ছার চুদুরবুদুর না।এর নাম চদরবদর।
বিডিও স্যার ভরসা দেন।
- আহ মুকুন্দবাবু, ওনাকে বলতে দিন না! এটা কেমন পুতুলনাচ! দেখাতে পারবেন আমাদের?
- কেনে পারব না! আমি তো জানতাম না আপনারা চদরবদর দেখিতে চান। তাইলে নিয়া আসতাম।
সারিন্দাটাও সঙ্গে আনা হয় নাই ছার, আপনাকে একটু গান
শোনাতে পারতাম।
- আপনি বরং কাল একবার আসুন, আপনার ওই কী জানি নাম! পুতুলনাচ নিয়ে।
- আজ্ঞে চদরবদর।
- হ্যাঁ ওইই। আমরা সরকারি প্রচার কাজে কিছু লোকাল শিল্পীকে লাগাতে চাই। তার আগে একবার আপনার ওইই পুতুলনাচ দেখে নিতে চাই।
খেকুরে নিজের মনেই বলে – কী নাম রে বাবা চুদুরবুদুর!
সুখেনের চোখে ততক্ষণে লেগে যায় শিল্পীর ঘোর। খেকুরেকে আর শুধরে দেয় না নামটা।
-সরকারি পচারে কী করতে হবে ছার?
-কিছুই না, আপনি যা করেন, তাইই। আপনি তো নিজেই গান বাঁধেন?
-আজ্ঞে।
-আমাদের কিছু প্রচারমূলক গান আপনাকে বাঁধতে হবে। যেমন গাছ কাটলে মানুষের কী কী ক্ষতি হয়।
তারপর বাল্যবিবাহ নিয়ে। আমি আপনাকে পয়েন্টগুলো বুঝিয়ে দেব। আপনি গান বাঁধবেন। এইজন্য পুতুল বানানোর যা খরচ হবে, বিল করবেন আমরা দিয়ে দেব। আর আমার এলাকায় যতগুলো হাট বসে, সেসব হাটে গিয়ে গিয়ে আপনাকে সেই পালাগুলো দেখাতে হবে। হাট প্রতি পাঁচ শো টাকা করে পাবেন। গাছকাটা নিয়েই আগে করুন দেখি। গাছ কাটলে মানুষের কী কী ক্ষতি হয়, সেটা আমি লিখে দিচ্ছি। আপনি গান বেঁধে দেখান আগে। তারপর পুতুল বানান, সে সব খরচা আলাদা দিয়ে দেব।
প্রথমে একটু হকচকিয়ে যায় সুখেন। হাট প্রতি পাঁচশটাকা! সুখেনের মেরে কেটে একদিনে আয় হয় আড়াইশো তিনশো। তাও বারবার করে গলায় ফেনা তুলে। ব্যাপারটা মন্দ না। এই এলাকায় কবে কোথায় হাট বসে সবটা জানা সুখেনের। অন্তত চারটা হাট পাবে ও। মাঝখানের একেকটা দিন অন্য কোথাও নিজের ইচ্ছায় যেতে পারবে।
৪
নদীর ধারে শিমূল গাছ
রাজা বলে কাট কাট
রাণী বলে না কাটেন
ছোট শিমূল বড় হবেক
চৌখুপ্পি বাক্সের ভিতরে দু'টি সারিতে ভাগ হয়ে মুখোমুখি নাচছে ৭টি পুতুল৷ ৪টি আদিবাসী মেয়ে৷ ৩টি ছেলে৷ তারা বাজাচ্ছে ধামসা আর মাদল৷ এই নিখুঁত পুতুলগুলোও তৈরি করে ফেলেছে সুখেন, এর মধ্যেই। খুব মন দিয়ে পালা বেঁধেছে। বিডিও সাহেবের পছন্দও হয়েছে পালাটা। বিডিও অফিসের কাজটা সুখেন শুরু করে দিয়েছে মহিষবাথানের মেলা থেকে এসেই। পালায় লোকও জমছে। আসছে কিছু বাড়তি পয়সাও।
নতুন বিডিও নাকি অনেক কাজ করছে এলাকায়। রাস্তা বড় করা হচ্ছে। একটা রাস্তা দিয়েই গাড়ি যাওয়া আসা করবে না আর। শিলিগুড়ির মতো একটা রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাবে, পাশেরটা দিয়ে আসবে। মাঝখানে নীল সাদা রঙ করা লোহার বেড়া বসছে। জীবনতলার হাটে যাওয়ার পথে নতুন রাস্তার কাজ হচ্ছে দেখল সুখেন। দু’পাশের বড় বড় শিরীষ গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। মড়মড় করে ভেঙ্গে পড়তে দেখল বহু পুরনো একটা শিরীষ গাছকে।
ছোট্ট থেকে এই গাছগুলোকে চেনে সুখেন। পাশের বটগাছটার গোড়ায় ভুতনাথ বাবার পূজা দেয় গ্রামের লোক। সেখানে এখন অনেক মানুষের জটলা। হাতপা নেড়ে গলার শির ফুলিয়ে কীসব বলছে। ভিড়ের ভেতর চেনা কিছু মুখও যেন দেখল সুখেন। ওর এখন মরার সময় নেই। জীবনতলার হাটে চদরবদর দেখাতে হবে। রাজারানির গল্পটা ভালোই জমেছে। গানটার কথায় বেদের মেয়ে জোৎস্না-র সুর বসিয়ে দিয়েছে সুখেন বুদ্ধি করে। এই সুরটা খুব টানে গ্রামের মানুষদের, জানে সুখেন। হাটের লোকজন ভিড় করে খুব উৎসাহ দিয়েছে। কিছু বাড়তি টাকাও জমে যায়।
হাট থেকে বাসায় ফিরতি পথেও দেখে, বটগাছটা ঘিরে তখনও কিছু লোক জমে আছে। একটু দাঁড়ায় সুখেন। বটগাছের বাঁধানো চত্বরে বসে কিছুটা জিরিয়ে নেয়। চেনাজানা লোকজনদের সঙ্গে একটু কুশল বিনিময় করে। ক্ষিতেন মুর্মু বলে শুনছিস নাকি রে সুখেন, এই সব গাছ কাটি নিবে সরকার। রাস্তা বড় করিবে। উন্নয়ন হবে।
- হ, কী যেন শুনতেছিলাম। হাটেও শুনলাম যেন। চওড়া রাস্তা হবে আয়গঞ্জের মতো। শিলিগুড়ির মতো।
দমনের কলেজপাশ ছেলেটা বলে,
-তাই জন্য সব বাপ-দাদার আমলের গাছ কাটিবার লাগিবে কেন হে কাকা? মাঝখানে গাছগুলান রাখি দিয়া, দুই দিকে রাস্তা করা যাইত না! জমি তো বেবাক ফাঁকা।
- সব্বোনাশ হবে, দেখি নিও। অক্তাওক্তি হয়া যাবে। বাবার থান কাটি ফেললে তেনারা যাবেন কুথায়? সগায় জানে এই গাছে তেনাদের বাস।
-
বাবার চেলারা
রাগি গেইল কী হবে কহেন দেহি চাচা?
ভর সন্ধ্যাবেলা তেনাদের
কথা বলে ফেলে দুইবার হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করে নেয় দমনের ছেলে। এই গাছ কাটা হলে
কার না কার বাড়ির গাছে গিয়ে বসবেন এই গাছের ভুত টা ভেবেই ভয় পায় সবাই।
-কাকা একটা গান বাঁধেন দেখি এই নিয়া! ভুতনাথ বাবার পূজার দিন যেলা পালা দেখাও তুমরায় অইটা করতি পারো। তেনাকে তো নিজের চক্ষেই একবার দেখসিলেন কাকা!
-কাকা একটা গান বাঁধেন দেখি এই নিয়া! ভুতনাথ বাবার পূজার দিন যেলা পালা দেখাও তুমরায় অইটা করতি পারো। তেনাকে তো নিজের চক্ষেই একবার দেখসিলেন কাকা!
বাবার থানের গাছটা কাটা যাবে শোনার পর থেকেই পরান ধরাস ধরাস করছে সুখেনের। বাবার চেলারা সব থাকেন ওই গাছে। সুখেন নিজে একবার স্বচক্ষে দেখেছে, থুরি দেখে নাই, চক্ষু বন্ধ করে রেখেছিল। সেইবার ওই মহিষবাথানের মেলা থেকে ফিরবার সময়ই মেলার থেকে একটা বড় মাছ হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে আসছিল্। বাবার থানের পাশ দিয়ে আসবার সময়, জয় বাবা ভুতনাথ, জয় ডংধরা বাবা বিড়িবিড় করতে করতে জোরে পা চালিয়ে জায়গাটা পেরোচ্ছিল। পেছন থেকে কে জানি নাকি সুরে বলল,
“মাঁছ খঁাব, সুখেন মাঁছ
দেঁ
সুখেন পেছনে না তাকিয়েই
অন্ধকারে দে দৌড়। বাসায় গিয়ে মাছ কেটে কুটে
রান্না করে পরদিন গাছের গোড়ায় নিবেদন করে গেছিল অর্ধেকটা।
।
সেই বটতলা। সেই বটগাছ।
কাটি দিবে! কোনো কথা মুখে জোগায় না সুখেনের।সেই গাছ কাটিলে ভুতনাথ বাবার চেলা তো মহা
ক্ষেপে যাবে। সবার কথায় হুঁ হাঁ ক’রে বেভুল
মনে তড়িঘড়িই বাসায় ফেরে সুখেন।একধামা মুড়ি আর একটা কাঁচালংকা হাতে ধরিয়ে বউটাও কত কথা
বলে যায়। কী কী যে সব বলে, কানে ঢোকে না। বেতের ছোট্ট ধামাটা থেকে মুড়ি নিয়ে চিবোতে
চিবোতে চুপ মেরে সব শোনে শোনে কি না, নিজেই বুঝতে পারে না। শুধু গুনগুন করে আউড়ে যায় নতুন পালাটা।
গাইতে গাইতে রোজই নতুন কিছু শব্দ পালটে পালটে যায়। আজ কী পালটাবে বুঝে পায় না সুখেন। বুকে খুব কষ্ট। সারিন্দাটা ঘরের খুঁটিটায় হেলান দিয়ে রাখা। খালি গলাতেই গুনগুন করে ও - ‘রাজা বলে কাট কাট’। এই একটা লাইনই মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। চোখ বুজলেই মড়মড় ক’রে ভেঙ্গে পড়তে দ্যাখে একটা শিরীষ গাছকে। দমনের ছেলেটার মাথা যেন শিরীষ গাছটার সমান হয়ে গেছে, বলছে
গাইতে গাইতে রোজই নতুন কিছু শব্দ পালটে পালটে যায়। আজ কী পালটাবে বুঝে পায় না সুখেন। বুকে খুব কষ্ট। সারিন্দাটা ঘরের খুঁটিটায় হেলান দিয়ে রাখা। খালি গলাতেই গুনগুন করে ও - ‘রাজা বলে কাট কাট’। এই একটা লাইনই মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। চোখ বুজলেই মড়মড় ক’রে ভেঙ্গে পড়তে দ্যাখে একটা শিরীষ গাছকে। দমনের ছেলেটার মাথা যেন শিরীষ গাছটার সমান হয়ে গেছে, বলছে
- কাকা একটা
গান বাঁধো দেখি এই নিয়া!
শুনে, চোখে শিল্পীর ঘোর লাগে। ঘোরের মধ্যে একটা লাইন ঘুরে ফিরে গেয়েই যায় সুখেন মুর্মু। রাজা বলে কাট কাট… এই লাইনটা বারবার ঘুরে আসতে আসতে হঠাৎ কানে আসে
- না কাটেন ছোট শিমুল বড় হবেক।
আধোঘোরে তাকায় সুখেন মুর্মু। পাতার পর পাতার স্তূপ। চারিদিকে শুকনো মরা গাছ। সেই বাবার থান বটগাছটার তলায় রাশি রাশি শুকনো পাতা। সেখানে এসে ঝাড়ু দিতে লেগেছে বউ। ঝাড়ু দিতে দিতে কী একটা যেন চেনা গান গেয়ে উঠছে বউটা। লাল পাড় শাড়ি পরনে, নাকে ফাঁদি নথ, গা-ভরা গয়না।
শুকনো পাতাগুলো ফরফর করে উড়তে থাকে। উড়তে উড়তে পাতাগুলো সব এক একটা কবুতর
হয়ে যায়। বউএর মাথায়, হাতে, কাঁধে কবুতর।
সুখেন যেন বিরাট খা খা করা একটা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে রুখা সুখা। কাঁধে, মাথায় জীবন্ত কবুতর নিয়ে মা দুগগা শাড়িটাকে মালকোঁচা
মেরে পরেছেন। মাথায় ফেট্টিবাঁধা। হাতে কোদাল কাস্তে। দেখতে দেখতে নাকের নিচে ইয়া বড়
মোচও গজিয়ে গেছে। জমি জিরাতের কাজ করছে দুগ্গা। দুগ্গা, না ভাণ্ডারী দেবতা! বিডিও সাহেব
আর খেকুড়েবাবুটাও চলে এসেছে কোথা থেকে। হাতে অনেকগুলা পাঁচশো টাকার নোট বাড়িয়ে ধরেছে
সুখেনের দিকে - এই নাও সুখেন, তোমার হাটবারের পালার টাকা।
সুখেন হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিচ্ছে। নিয়েই উড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে। ফরফর করে উড়ে যাচ্ছে টাকাগুলো। উড়তে উড়তে কবুতর হয়ে যাচ্ছে।
সুখেন হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিচ্ছে। নিয়েই উড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে। ফরফর করে উড়ে যাচ্ছে টাকাগুলো। উড়তে উড়তে কবুতর হয়ে যাচ্ছে।
চটকাটা ভাঙ্গতেই আবার
যে কে সেই। মাথাখান আউলাঝাউলা হয়ে যায়। নিজের
বানানো গান থেকে দু এক কলি আউড়ায় সুখেন। বিডিও সাহেব নিজে বলে বলে দিয়েছিল গাছ কাটলে
কী কী ক্ষতি হয় মানুষের। তার ওপর সব “তেনাদের”
গাছ কাটলে অন্য ক্ষতি হবে, সেটা উপরি। তাড়াতাড়ি জামাটা গলিয়ে বিডিও অফিসের দিকে ছোটে
সুখেন।
বিডিও সাহেবের অফিসে
যেতে এখন আর ভয় পায় না ও। সোজা চলে যায় বিডিও সাবের ঘরের দোরে, নীল পর্দাটায় হাত বোলায়।
কী বাহার কাপড়টার, আলো ঠিকরায় যেন, পর্দাটায় হাত বোলাতে বোলাতেই উঁকি দেয় সুখেন,
-ছ্যার, ভিতরে যাব?
- আসেন, বলেন! কী খবর?
কাজ হচ্ছে?
- হ্যাঁ ছ্যার, লুকে ভালাই নিসে পালাখান।কাথা সেইটা না। কাথাখান
অইন্য
- কী হয়েছে? টাকা পান
নি? টাকা মুকুন্দবাবুর কাছ থেকে নিয়ে যান।
- না ছ্যার বেত্তান্ত
অইন্য। গাছ কাটিলে তো অক্সিজেন কমি যায়, তা
বাদে স্বাস নেওয়া যায় না। বিষ্টি কমি যায়। রুখা সুখা হয়ে যায় মাটিখান। সইত্য কিনা!
আপনিই কয়ে দিসিলেন। তাইলে মোক গাওখান কী সুকায়
যাবার ধরিবে এলা? অত্তগুলা গাছ তুমরায় কাটিবার ধরিসেন, আস্তা করিবার তানে। তা বাদে
ওই ভুতনাথ বাবার থানের গাছখান কাটিবার ধরিসেন।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো
বলে হাঁফ ছাড়ে সুখেন, সাবানের ফেনার মতো বুড়বুড়াচ্ছিল কথাগুলো। একবারে বলে ফেলে যেন
মুক্তি পেল সুখেন। শ্বাস নিল প্রাণ ভরে।
বিডিও সাহেবের বালক বালক
মুখটা বয়স্কদের মতো দেখায়, হাতের কলমটাকে থুতনিতে
ঠেকিয়ে তিনি সামনে রাখা কাগজটায় অত্যাধিক মনযোগে ঝুঁকে পড়েন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলেন।
-
হাটবারের
পালা দেখিয়ে আপনার যা টাকা হয়, তাতে চলে যায় সংসার?
-
দুই- হাজার
টাকায় কী হয় আজিকাল! কন? অইন্য মেলাগুলায় যাবার লাগে।
-
তা অন্যান্য মেলায় যেতে আপনার কত সময় লাগে সুখেনবাবু? অন্য গ্রামে
মেলা হলে একদিন গিয়ে পরদিন ফিরতে পারেন? পারেন না। তাই তো! গাছ কেটে রাস্তা হলে আপনি যে পথটুকু হেঁটে কিংবা
ভ্যানে যান আধবেলা ধরে, সেই পথ আধ ঘণ্টায় চলে যেতে পারবেন বাসে। উন্নয়ন তো দরকার! নাকি! আর আপনি তো আমাদের লোক। সরকারের হয়ে কাজ করেন।
এইরকম তো ভাবে নাই সুখেন। কথা তো মিথ্যা না। ভুশভুশ করে বড় বড় গাড়ি যাবে এই
রাস্তা দিয়ে, সেইটা ভালো কথা। এইখান থেকে হেঁটে, তারপর ভ্যানে গিয়ে তারপর বাস
ধরতে হয়। তিন চার ঘণ্টার পথ হুশ করে পৌঁছায় যাবে বড় রাস্তা হলে, সেই টাও কম কথা না। গ্রামের মানুষের বাইরে যাবার দরকার পড়ে না, ওরা বোঝেও না রাস্তা
ঘাটের অবস্থা। সুখেনের তো তা না। তাকে হর দিন বাইরে যেতে হয়। মহা আতান্তরে পড়ে যায়
সুখেন। তাইলে কোনটা ঠিক! গাছ কাটা না উন্নয়ন?
গাছ না কাটলে উন্নয়ন হবে না। উন্নয়ন উন্নয়ন শুনছে অনেকদিন সুখেন। এইটাই তাহলে উন্নয়ন! তাইলে
ভুতনাথ বাবার থান! তার কী হবে! বিডিও সাহেবের
কথায় চটক ভাঙ্গে সুখেনের।
-
আপনি বরং
এবার আরেকটা গান বাধেন, উন্নয়নের গান। আমি বলে দেব পয়েন্টগুলো। গ্রামের লোকদের সহজে
বোঝাতে হবে। আপনাদের ভালোর জন্যই তো রাস্তা হচ্ছে। নাকি! গ্রামের লোক পিটিশন দিয়ে গেছে কাল। ওদের যা বলার আমি বলেছি, এখন আপনাকে আপনার কায়দায়
বোঝাতে হবে। ভুতনাথ বাবার স্থায়ী মন্দির আমরা
করে দেব পাশে।
-
বাবার মন্দির!
আর তেনারা! বিড়িবিড় করে বলে সুখেন, গলার জোরটা যেন আগের চেয়ে কমে আসছে মনে হয়।
-
আপনি নতুন
পালার জন্য পুতুল তৈরির খরচ নিয়ে যান মুকুন্দবাবুর কাছে। আপনার “তেনাদের” জন্য মন্দিরের পাশে নতুন গাছ পুঁতে দেব। ফুলও ফুটবে দেখবেন সেই গাছে। তরতর করে বাড়বে। আপনার
রেট পাঁচশ থেকে সাতশো করে দিতে বলছি, হাট পিছু।
হতভম্ব হয়ে সুখেন ভাবে,
হাটপিছু দুইশো টাকা বাড়লে সপ্তাহে কত টাকা! মাসে কত হয়! অঙ্কটা চলতেই থাকে মাথার মধ্যে। একেকবার একেক রকম সংখ্যায় দাঁড়ায়। অংক মেলাতে মেলাতে নিজেকে মনেহয় চদরবদরের পাটাতনের
মাথার ওপর খেলা দেখিয়ে যাওয়া বড় পুতুলটার মতো।
অংকটা কিছুতেই মেলে না।
বিডিও অফিস ছেড়ে পায়ে পায়ে
কখন যে হাঁটা দিয়েছে সুখেন। আকাশে ঘন হয়ে মেঘ জমছে। অন্ধকার হয়ে আসছে পৃথিবী। ঘর-বাড়ি,
টাকা পয়সা, বউ-বিডিও, সব যেন মুছে যাচ্ছে
ওই ঘনঘোর আকাশের দিকে তাকিয়ে।
ওই তো ওই তো সেই বটতলা। হাল্কা সবুজ অন্ধকার থেকে কারা যেন নাম ধরে ডেকে উঠল
তার
– ‘সুঁখেন, মেলা টাকা পায়ে ব্যবাক
ভুলি যাবা ধরিছিস বাউ!’
পেটের ভেতর থেকে যেন উঠে আসছে ডাকখান। সেঁধিয়ে যাচ্ছে হাত-পা। কোনদিকে
যাবে সুখেন! বেঁচে থাকার জন্য কোনটা আগে দরকার! ঠাওর করতে পারে না। দুনিয়ার অন্ধকার
নেমে আসতে থাকে ভুতনাথ বাবার থানে।
No comments:
Post a Comment