Wednesday, August 5, 2020

দেবমাল্য চক্রবর্তী








মা নিষাদ

 

‘শয়তান, তুই নরকে যাবি

পাপ-পুণ্যের জ্ঞান নেই তোর,

শয়তান, তুই নির্ঘাৎ নরকে যাবি

অভিশাপ দিচ্ছি তোকে, তুই নরকে যাবি’

দস্যুর নরকযন্ত্রণার ভয় নেই বুঝি?

সে ভয় তো রাজাকেও ছাড়ে না,

রত্নাকর দস্যুকুলশ্রেষ্ঠ

তবে তার যুক্তি ছিল,

‘ডাকাতিই তো জানি শুধু করতে,

বৃদ্ধ মাতা-পিতা, স্ত্রী-সন্তানদের আহার জোগাই খুন করে

ওহে ব্রাহ্মণ, তুমি বৃথা ফন্দি আঁটো কেন?

পুণ্য-টুন্য আমার দেখিয়ো না, মরার জন্য প্রস্তুত হও’

‘নিরপরাধদের সর্বস্ব লুঠ করিস, গর্দান নিস,

তা কি তো বাড়ির লোকে জানে’?

‘বলি না, বলতে যাব কেন?’

কিন্তু বিবেক? সে তো রত্নাকরেরও ছিল,

তখনও তো সে রাম আর মরার মধ্যে

তফাত করতে জানত না

বাড়ির লোক, যাদের জন্য

সে অন্ন আনত রক্তে হাত ধুয়ে,

তারাই যে তাকে অভিসম্পাত দেবে,

ঘৃণার পাত্র হবে সে, ভাবত না

পাপের ভাগ কেউ নেয় না,

সবাই পুণ্যের জন্য কলসী খালি করে

অতএব ফেরত এসেই ব্রাহ্মণকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল,

‘ঠাকুর, আমার কী হবে?’

ব্রাহ্মণ অবশ্য প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল,

‘সব ছেড়েছুড়ে গাছের নীচে তপস্যা কর ব্যাটা বসে’,

‘তপস্যা আবার কী জিনিস ঠাকুর?’

‘গাছের নীচে চোখ বন্ধ করে বসে বলবি,

মরা...মরা...মরা...ম...রাম..রাম...রাম’

এ দেশে কি তবে দস্যুরাই রামায়ণ লেখে?

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ

যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধঃ কামনোহিতম্!

রামের মধ্যে রাজনীতি তখনই প্রবেশ করেছিল কি তবে?

কামমোহিত ধর্ম যখন ভক্তের সঙ্গে মৈথুনে রত,

তখনই কি তবে জেনেবুঝেই বাণ মারে কোনও নিষাদ?

বাল্মিকী শাশ্বত, রামও, মরাও,

তবে দস্যুরাই হয়তো রামায়ণ লেখে


Saturday, May 5, 2018

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে





"টয়কে একা রেখে মিথিল আর মিমি একসঙ্গে কোথাও অনেকদিন যায়নি। যাওয়ার কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। কিন্তু মিথিলই অফিস থেকে ফোন করে মিমিকে বলল যে মহেন্দ্রর বাড়িতে সন্ধেবেলা তারকোভস্কির ‘নস্টালজিয়া’ ভিসিআর- এ দেখার খবর। অমিতাদিকে বলে টয়-কে দেখার একটা ব্যবস্থা করতে। একটেরে ছোট্ট তিনতলা ফ্লাটবাড়ির ওপরতলাটায় লোক নেই। রোগা বাড়িটাতে একটাই করে ফ্লাট এক এক তলায়। দোতলায় টয়রা। একতলায় অমিতাদি। আর এগোবার আগে একোরিয়ামের ব্যাপারটা জেনে নেওয়া যাক। 
গতবছর মিথিলের অফিস থেকে বেশ ঝামেলা পাকিয়েছিল। মিথিলের ডিভিশনের বস রিটায়ার করলেন। তাঁর জায়গায় নতুন একটা লোক বম্বে থেকে এল। ওখানে কোনো টাটা কনসার্নে ছিল। আর এল তো এল শুরু হল খাটাখাটি। এটা নিয়ে খুচরো ঝামেলা, ওটা নিয়ে খিঁট। শুরু হল মিথিলের টেনশন। সেই সময় মিথিল যোগব্যায়াম শুরু করল। প্রাণায়াম, শবাসন। যে ছেলেটা যোগ শেখাতে আসত সেই মিথিলকে বলেছিল বাড়িতে একটা একোরিয়াম আনতে। সে ছিল শ্রীঅরবিন্দ ও মাদারের ভক্ত। মাদারের কোনো লেখায় নাকি আছে একোরিয়ামের মধ্যে মাছ দেখলে মন খুবই শান্ত হয়। কয়েকজন এটা করে বেশ ভালো ফল পেয়েছে। অতএব একধরনের চিকিৎসার প্রয়োজনেই একোরিয়ামের আবির্ভাব। খুব বড় নয়। বেশি মাছ ধরেও না। সোর্ডটেল, গাপ্পি, এঞ্জেল, ব্লাক মলি, গোরামি। পরে এসেছিল ক্যাট ফিশ। কেঁচো রাখা হত বাথরুমে। ফোঁটা ফোঁটা জলের তলায়। অনেক ঝামেলা। তাই ড্রাই ফুড এল। মিথিলের দেখাদেখি টয়ও বাবার মতো টিভি না দেখে একোরিয়াম দেখার নেশায় মেতেছিল। বুক ফেয়ার থেকে মিথিল আর মিমি টয়কে ‘মাল্টিকালারড ফিনস’ বলে একটা বই কিনে দিয়েছিল। সেই বইটা পড়ে টয় একদিন বলেছিল,

--বাবা, আমাদের মাছের ঘরে ফাইটার নেই কেন?
--ও এনে লাভ নেই। নিজেরাই মারামারি করে মরবে।
--বইটাতে কিন্তু লিখেছে ওরা মেরে ফেলে না। পাখনা ছিঁড়ে দেয়। আবার গজায়।
--তুই পড়েছিস?
--হ্যাঁ। এঞ্জেলের ভালো নাম কী বলো তো?
--কী?
--টেরোফাইলাস এমিকেই।
সেই সন্ধেবেলায় টয় ঘণ্টায় ঘণ্টায় কী করবে খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিল মিমি। সাতটায় যেন ভালো ছেলে হয়ে কমপ্লান খেয়ে নেয়। রাতে ফ্রুট কাস্টার্ড। তা ছাড়া টয়-এর জন্য একটা সারপ্রাইজও আসতে পারে। টিভিতে কোনো বাচ্চাদের প্রোগ্রাম নেই। থাকলে ভালো হত। কমপ্লান খেয়ে নিয়ে টয় যেন পড়তে বসে। আটটায় অমিতাদি এসে দেখে যাবে। দারোয়ান-ও খেয়াল রাখবে। তেমন চেনা না হলে দারোয়ানই বলে দেবে পরে আসতে। যদিও কারো আসার কথা নেই। আর মিমিরা তো সোয়া নটার মধ্যে এসে যাবেই। অবশ্য এতো শান্ত, ভদ্র আর চুপচাপ ছেলে যে তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। এটা মিমি আর মিথিল জানত। মিমি বাড়ির সামনে থেকে মিনিবাসে উঠে গেল। টয় বারান্দা থেকে হাত নাড়ল। তখন সোয়া ছটা। চারটে স্টপ পেরোলেই মহেন্দ্রদের বাড়ি।

টয় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে গাড়ি গুনল। সেই খেলাটা খেলল। ইচ্ছেমতো গাড়ি আনা। খুব একটা শীত পড়েনি এবার। যদিও সূর্য তাড়াতাড়ি ডুবছে আর আলোর পাশে ধোঁয়া ধোঁয়া। ইচ্ছেমতো গাড়ি আনার খেলাটা টয়-এর তৈরি। টয় ছাড়া এই খেলাটার কথা কেউ জানে না। এইবারে একটা এম্বেসাডর আসবে। এল। ওয়ান নিল। এবার মারুতি। তার বদলে একটা পুলিশ ভ্যান। ওয়ান ওল। এবারেও মারুতি। মারুতি টু টু ওয়ান। সাইকেল টু হুইলার, বাস, মিনি—এদের এই খেলায় ধরা হয় না। ফ্লাটের তিনটে ঘরেই আলো জ্বলছে। ৪৫—৩৭-এ জিতে টয় যখন কমপ্লান খেতে গেল তখন সাতটা পাঁচ। সোয়া সাতটায় মিথিল-মিমির ফোন।
 

--সব ঠিক আছে তো?
 
--হ্যাঁ।
 
--ভয় করছে না তো?
-- না।
 
--পাঁচটা অঙ্কের হোম টাস্কটা শেষ করে রাখলেই হবে। হাতের লেখাটা কাল সকালে করবে টয়।
 

টয় ফোন রেখে দিয়ে অঙ্ক নিয়ে বসল। অঙ্কগুলোর মধ্যে শেষটা ছিল কঠিন আর বড়। অনেকগুলো গুন-ভাগ। শেষ অঙ্কটার সময়েই দরজায় বেল। অমিতাদি!

--কী করা হচ্ছে টয়বাবু?
--হোম টাস্ক করছি। অঙ্ক।
--এতো ভালো ছেলে আমি কখনো দেখিনি। ভয় করছে না তো?
--একটুও না।
অমিতাদি টয়কে চারটে হজমোলা ক্যান্ডি দিয়ে গেলেন। টয় নিজের টেবিলে দুটো রাখল। দুটো রাখল বাবা-মার খাটের পাশের বেডসাইডের ওপর। অঙ্ক শেষ অব্দি হল না। তখন আটটা দশ।

তারপর টয় বাথরুমে গিয়ে হিসি করল। ফ্ল্যাশ টানল। তারপর বাথরুমের পাশের দেওয়ালে, টয়ের হাতের নাগালের বাইরে, যে বাক্সটা লাগানো আছে, সেটা কমোডের ওপরে দাঁড়িয়ে খুলল। খুলতেই চমৎকার একটা গন্ধ। ইউ ডি কোলন, আফটার শেভ লোশন সব মিলিয়ে। মিথিল টুরে গেলে একটা ছোট্ট, মিনিয়েচার, অসম্ভব কিউট দেখতে ইমারসান হিটার নিয়ে যায়, দাড়ি কামাবার জন্যে জল গরম করে, সেটা নামাল।

মিথিল, মিমি ঠিক সাড়ে নটায় বাড়িতে ফিরেছিল। ফিরে দেখেছিল টয় মন দিয়ে টিভি দেখছে। কেবল টিভিতে তখন অস্ট্রেলিয়াতে পিংক ফ্লয়েডের একটা লাইভ প্রোগ্রাম। সাইকোডেলিক আলো। ধোঁয়া। স্নো মেশিনে বড় বড় চুলের ঢেউ। নীল গিটারের তারে বিদ্যুতের মতো চড়া আলোর ঝলক। ওরা টয়ের জন্য আইসক্রিম এনেছিল। টয় তাই খাবার পরে কাস্টার্ড খেল না। টয় ঘুমোতে চলে গেল। মিমিও টয়ের পাশে শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মিথিলের ঘুম আসেনি। নস্টালজিয়াতে মোমবাতির আলোগুলো তাকে ঘিরে যেন জ্বলছে। পরে একটা মোমবাতির আগুন বাঁচানোর জন্যে...মিথিল দেখল তার মাথায় আবার সেই অস্থিরতটা হচ্ছে। সিগারেট নিয়ে একোরিয়ামের সামনে বসা যায়!

একোরিয়ামের আলো জ্বলছে। ওপরে টিনের ছোট্ট ঢাকাটা সরিয়ে একটা পেন্সিল আড়াআড়ি রাখা। তার থেকে ঝুলছে ছোট্ট ইমারসন হিটার। মাছগুলো মরে গেছে। ইমারসন হিটারটা জ্বলছিল বলে জলের মধ্যে একটা অদৃশ্য তরঙ্গ সৃষ্টি করে গরমজলের ওপরে ওঠা ও ঠাণ্ডা জলের নীচে নামা চলছে। সেই অদৃশ্য স্রোতের মধ্যে মরা মাছগুলো কখনো উলটে, কখনো কাত হয়ে সরে সরে যাচ্ছে! জলটা বেশ গরম। ডুবুরি পুতুলের মুখ ফাঁক হয়ে রুপোলি বুদবুদ উঠছে। ইমারসন হিটারের গা থেকেও ছোট ছোট বুদবুদ উঠছে।

পরদিন টয় স্কুলে যায়নি। টয়কে নিয়ে তার বাবা-মা সাইকিয়াট্রিস্ট দিব্যেন্দু মুখা্ররজির কাছে যায়। উনি মিমির মামার চেনা। মিথিল ও মিমি বাইরে বসেছিল। ডঃ মুখার্জি প্রায় ঘণ্টাখানেক টয়কে নিয়ে ভিতরে ছিলেন। পরে যখন ড: মুখার্জির সঙ্গে চেম্বার থেকে বেরিরে এল তখন টয়ের হাতে আমুল চকলেট আর দুজনের মুখেই হাসি।
--মিঃ টয়, তুমি বসে এই ছবির বইটা দেখতে থাক, আমি একটু বাবা-মার সঙ্গে কথা বলে নিই।
টয় ঘাড় নাড়ল।
ড: মুখার্জি বললেন, ওফ কত গল্প যে হল আমাদের। ভেতরে ড: মুখার্জি মিথিল ও মিমিকে বলছিলেন। 
--ঘটনাটা আপনাদের কাছে যতটা ম্যাকাবার মনে হচ্ছে আমার মতে সেটা খুব সিরিয়াস কিছু নয়। আমি ওর সঙ্গে কথা বলে, যেটাতে বিশেষভাবে ইম্প্রেসড সেটা হল, আপনাদের ছেলের মধ্যে একেবারে এগ্রাশন নেই। এত মিষ্টি, ঠাণ্ডা মন.. আপনাদের আমি বলব ব্যাপারটা ইগনো করতে। এটা কোনো প্রবলেম নয়। হি ইজ পারফেক্টলি নরমাল। সর্ট অফ কিউরিসিটি..অল মোস্ট সায়েন্টিফিক...।

এই ঘটনার কিছুদিন পরে, একটি বিদেশি পত্রিকাতেও ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কয়েকজন হত্যাপরাধী শিশুকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ পড়েছিল মিথিল। ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ নিয়ে বিতর্ক জমে উঠেছে। তার মধ্যে জনৈক ফরাসি মনস্তত্ত্ববিদ বলেছিলেন যে রকম ঠাণ্ডা মাথায়, নির্লিপ্তভাবে এরা নিজেদের অপরাধের বর্ণনা দিয়েছে তাতে মনে হয় যে এর মধ্যে কোথাও একটা বিজ্ঞানমনস্কতার ব্যাপারও রয়েছে। মিথিল মিমিকেও পড়াল।
 

টয়কে নিয়ে তার বাবা-মার দুশ্চিন্তা আর থাকল না।"

( টয়/ নবারুণ ভট্টাচার্য)




সম্পাদকমণ্ডলী - বেবী সাউ   মণিশংকর বিশ্বাস   হিন্দোল ভট্টাচার্য
যোগাযোগ - abahaman.magazine@gmail.com

স্মরণ







                                                           
                                                                 ড অশোক মিত্র
                                                                (১৯২৮-২০১৮)

কিছু কিছু ছোটসাইজের কবি শিল্পী ক্রমাগত চিমটি কেটে গেলেও, জীবনে এত এত বড় মানুষের সানিধ্য, ভালোবাসা পেয়েছি যে নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান মনে হয়। আমার জীবনে তেমনই এক বটবৃক্ষ এই মানুষটি। আজ তিনি বিপন্ন, অসুস্থ।
এই মানুষটিই প্রথম আমায় আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন আরেক বিরাট মানুষ অশোক সেনের সঙ্গে। আমার এবং আমার লেখার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি 'বারোমাস'-এর বিদগ্ধ সম্পাদককে এত ভালো ভালো কথা বলেছিলেন যে, লজ্জাবনত আমায় সরাসরি অশোকবাবু বলেছিলেন, "আজ থেকে তোমায় প্রতিবছরের শারদীয়া বারোমাসের জন্য লেখা আমন্ত্রণ করছি।" আমার শরীরে শিহরণ তখন। কবি সাহিত্যিকদের কাছে 'বারোমাস'-এর মর্যাদা যে কতখানি, তা নিশ্চয় বলে বোঝাতে হয় না। সেই থেকে অশোকবাবুর মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি বছর নিরবচ্ছিন্ন 'বারোমাস'-এ লিখে গেছি। এ আমার জীবনের এক পরম প্রাপ্তি। আর সেই প্রাপ্তির মূলে এই মানুষটি।
নিরহংকার, সদালাপী, জ্ঞানতাপস, ঈশ্বরের মতো নিষ্কলঙ্ক এই মানুষটির চরণস্পর্শে সমৃদ্ধ হয়েছি বহুবার। শেষদিকে উনি আর শুনতে পেতেন না আমার কথা। তাই টেলিফোন করা বন্ধই করে দিয়েছিলাম। দেখা করে লিখে লিখে কথা বলতাম।
তিনি আর নেই আমাদের মধ্যে। মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছে। 

- রজতশুভ্র মজুমদার



ফিরে পড়া কবিতা - প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত





পূর্বপট

তখনও জানোনি দেয়ালের বাধা ছাড়িয়ে
কেউ যে জ্বালছে অন্যঘরের দেয়ালী,
সর্বনাশা যে, তার ত্রিললাট মাড়িয়ে
গোপনগঙ্গা প্রস্তরে খামখেয়ালী।

তুমি একবার বিস্মিত হয়ে তাকালে
দেখতে, কঠিন, ভ্রুযুগবিদ্ধ ধনুতে
সার্থকতমা উমার অঙ্গে, কাঁকালে
কুমার আসছে; ইঙ্গিত বরতনুতে ।



একটি মৃত পাখি

পাখি মরে আছে,
পাখি বরফের স্তুপের ভেতরে মরে আছে ।
ছিল কি কোথাও আগে? বাসা বেঁধেছিল
পোড়ো জমিটির নীল গাছে?
নাকি হাওয়ার ফিকিরে, ঘুরে ফিরে,
এসে মরে গেল এই দুনম্বর বাড়ির শিবিরে ।

মাথা গুঁজে আছে,
যেন বরফের ভেতরের ঘর,
সিঁদ কাটতে চায়; যেন ব্যালেরিনা,
ভার পালটাতে গিয়ে আস্তে থেমে আছে-
ঘুরে গিয়ে, এক ঝাপটায়
আবার ভরাবে শূন্য শব্দময় রঙিন ডানায় ।

কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে, মনে হয় ।
কিছু আগে ঈশ্বরের শেষ ক্ষমা করবার সাধ
মিটে গেছে। আজ শুধু শীতের আলোয়
ধবল নিঃসঙ্গ পাল
মেঘ-ছিন্ন, জলে পড়ে আছে,

পাখি মরে আছে,
পাখি শীতের ভেতরে মরে আছে ।

 অন্যভাবে নয়

কিছু হয়নি, কথার ভারে থেমে আছে,
         দুলিয়ে দাও, তাকে কর দ্রাক্ষালতা,
          তাকে ফোটাও অন্ধকারে আঁকাবাঁকা
মাঠের ওপর প্রতীক্ষিত সিসুগাছে-
কিছু হয়নি, আপাতত কিছু হয়নি।

ওরা ভীষন কথা বলে, ওরা কারা?
         কিছু হয়নি, আকাশ-ভরা তারা জানে,
প্রেমিক দেখে প্রেমিকাটির ভীরু চোখে
          ত্বরান্বিত , গাঢ় আয়না-
          কিছু হয় না, অন্যভাবে কিছু হয় না ।


আগামী নির্বাচন

কবিতা, কবিতা লেখা, কবিতার মধুর দালালি-
এখন কিছুই আর করতে পারি না।
বলতে পারি না পাড়ার ছেলেকে
                        কিছু ভোট দিন,
এ-যাত্রা তরিয়ে দিন তরুন ভুবনে ।

স্মৃতি-বিস্মৃতির ফাঁকে দু একটি মানুষ
              শুধু উঁকি দেয়। কিছু বা জোনাকি
জামরুল গাছের ঘর আলো করে থাকে।
সবারই স্বভাবচরিত্র খুব ভালো মনে হয়-
             কারো কবিতা হবার দিকে
চেষ্টা দেখি না,
বলতে পারি না ; পাড়ার ছেলেটি এই
            দাঁড়িয়ে রয়েছি
দিন, ভোট দিন, কিছু ভোট দিয়ে আমাকে বাঁচান।

কবিতা, কবিতা লেখা,কবিতার অমল দালালি-
            এখন কিছুই আর করতে পারি না ।

ভিতর বাহির

এক সময় সুতো ছিঁড়ে যায়-
আমরা তখন বিবস্ত্র , একাকী,
হাওয়া শুধু অন্য হাওয়া নাচায়,
চতুর্দিকে ফাঁকি।

বাহির তবু যথেষ্ট আশ্রয়
কখনো নয় বলে আবার ভেতর
নতুন করে তৈরি করতে হয়,
পোড়া-ইঁটের ঘর?

আমরা কিন্তু অন্যরকম চাই-
একটিবার চূড়ান্ত যাচাই
বাহির, এবং ভিতর ।


এই মূর্হুতের কবিতা

কেউ আসে, কেউ আর ফিরেও আসে না।
            কাঁটা বাবলার গাছে ফুল ফুটে আছে ।
একটা এরোপ্লেন শুধু একদৌড়ে মেঘ পার হল ।
           তুমি কি তৈরি করতে পারবে এখুনি?
ভিতর-বাহির সব জড়ো করে শাঁখে ফুঁ দাও ।
          খেলা শুরু করো ।

কেউ আসে, কেউ আর ফিরেও আসে না।
         দ্যাখো, সমস্ত পৃথিবী পড়ে আছে ।


মানুষ, ১৯৬১

ভাঙা ঘরে, মস্ত একটা হাওয়ায়,
মানুষ কাঁপছে;
একটা হাত পাশের মানুষীকে
ধরে আছে, আরেকটা হাত
কোথায় রাখবে-বুঝতে পারছে না,
পায়রা এসে বসেছে নিমগাছে।

সামনে শুধু রুদ্র এক পাহাড়
সামনে এক প্রচণ্ড ঝামরানো
সমুদ্রের ক্লান্ত অন্ধকার।

আড়াল করে দেখে নেবার মতো
কোথাও আর গোপন দৃশ্য নেই ;

মস্ত একটা হাওয়ায়, ভাঙাঘরে
মানুষ কাঁপছে ।



তৃষ্ণার ভেতর থেকে

তৃষ্ণার ভেতর থেকে পাখি উঠে আসে।
হে ঝর্ণা আমার,
প্রতিটি শব্দকে তুমি সদ্যোজাত শিশুর মতন
দোলাও দুহাতে, তুমি প্রতিটি পাহাড়
প্রতিধ্বনি দিয়ে ভাঙো, নাম ধরে ডাকো-
যেন এইমাত্র চড়ুইভাতির
বন্ধুরা চলেছে ফিরে ভ্রমর-রঙিন কোনো গ্রামের ভেতরে।

তৃষ্ণার ভেতর থেকে পাখি উঠে আসে।
আমি স্পষ্ট দেখি, আর ভাবি;
কত দিব্যদেহ ধরে
অনুপম বীথির শরীর, কত রং ঝরে
বার্লাকবিস্তৃত এই আলোর শহরে।
হে ঝর্ণা আমার,
তোমার তৃষ্ণার ছলে পাখি ওড়ে আমার আকাশে ।


নিরাভরন

শব্দ থেকে ঘুঙুর খুলে নি,
বাজুক একেলা।

মানুষজনের স্মৃতি ঘরের ভেতর-
ঘরের বাইরে? পশুপাখি, আরো মানুষ, অফুরন্ত খেলা,
শব্দে সব ধরে?

যদি তেমন ভেতর শক্ত হয়
তাহলে আর বানানো বাজনার
প্রতিধ্বনি কেন?

বাংলা ভাষা বড় হচ্ছে সমস্ত সময়-
এখন তার চরণ থেকে অবাঞ্চিত নূপূর
সরিয়ে নাও,

বেজে উঠুক শুধু-পায়ের খেলা ।



অনন্ত মূর্হত

যা বলতে চাও
          ঠিক সেদিকে স্পষ্ট করে তাকাও ;
কিছু নয়, বিশেষ কিছু নয়
দরজা খোলা পড়ে ছিল; ফাঁকা রাস্তা;
         কোথাও কেউ নেই-

বাঁ-দিক থেকে একটা লোক এল !

কী বলতে চাও? পৃথিবী যে পলকে পলকে
        পালটে যায়, সে তো সবাই  বলে গেছে,
তবু যখন খোলা-রাস্তা একটিমাত্র লোকের তালে মাতাল
তখন তুমি কথা বলতে চাও- যেন তুমি মুখোস খুলে
       আলো দিচ্ছ লন্ঠনের মতো-

অমন করে জ্বলতে চাও কেন?

সদর স্ট্রিটের বারান্দা

বারান্দা, রেলিং সব কাছে ছিল
আমি দাঁড়ালাম, আর
ভোর হয়ে এল।

দেখলাম-
আর পাঁচজন বেশ সুস্থ, স্বাভাবিক,
চলার আদল যেন মূর্তিমান ছাঁচের আদল-
টান দিলে হাওয়ার ভেতর ভরে ওঠে।

শুনলাম-
মাতাল লোকটা নাকি মারধোর করেনি মেয়েকে,
চটি ঊড়ে এসেছিল দৈবাৎ হাওয়ায়ার জোরে
পাঁচিল ডিঙিয়ে,
আজ তার দু-নম্বর মেয়েটির কান্নার শ্রাবন
এই পাড়ার শানাই।

বুঝলাম-
যা কখনও ঠেকানো যাবে না
তা এতই একান্ত, সহজ,
তাকে নিয়ে জল্পনা করাও

যেন চোখ বেঁধে চলা ।


প্রেরনা

প্রথম ধাক্কা কিন্তু বাইরে থেকে আসে;
                              ট্রামের হাতল ছুঁয়ে অভিন্ন কনুই বেঁকে যায়।
যা কিছু বলতে চাও, তার ভেতরের দিকে নামে নীরবতা,
কিন্তু যা কখনোই শুরু হতে পারে না, সেখানে
                                 কিছুই কি ঘটে?

বাহির-ভুবন শুধু চাপা-দীর্ঘশ্বাস মনে হয়।
একটা জানলা তুমি খোলা রাখ, কিছু মানুষের শব্দ
                                যেন কাছে আসে ।



অন্য কবিতার প্রতীক্ষা

ধরে ধরে কবিতা লেখার হাত
ভেঙে যায়, থাকে শুধু গাভীর মতন নীরবতা।
দাঁত-করাতেরা সব বনের ভেতর থেকে শিস দিয়ে ওঠে-
কবিতা কি তা মতো? মৃদু ও অমোঘ ? অবারিত

বুকের ভেতর থেকে বুকের বাইরে আলো ধরে?
ঝরা-পাতা ঠেলে তার ভাঙা সাইকেল নিয়ে এসেছে যুবক,
সে কি সিগন্যাল করে কবিতায়? করে কি জোনাকি?
ধরে ধরে কবিতা লেখার হাত থেমে যায়,
                                             থেমে যায় ফাঁকি ।।

এ খেলা সহজ নয়

এ খেলা সহজ নয়, জলের ওপরে এক বিমূঢ় কলস ভেঙে যায়,
এখন কোথায় তবে কতটুকু ধরে রাখা যায়, কেন যাবে?
জলে দৌড়ে যায় জল, বিমূঢ় কলসে আর কিছুই ওঠে না ।

যদি শক্তি কিছু হত, ঠেকে যেত হাতে বা ভেতরে,
ইঁট বা কাঠের তৈরি, হাতির দাঁটের কৌটো পাথরে বাঁধানো,
অথবা এমন কিছু, গিঁঠ দিলে রুমালে আঙুল থেকে যায়।

এ খেলা সহজ নয়, জলে দাঁড় ফেলে জল, জলের আড়ালে
শুধু আমাদের দেহ কিছুটা সাঁতার কাটে, বাকিটা পারে না-
যদি ভরে নিতে চাই, জলের ভেতরে এক উন্মাদ কলস ভেঙে যায় ।


বৃত্ত

আমি যেখানেই যাই
কিছু পরে
বৃত্তের ভেতরে ফিরে আসি ।

বুক বাঁধি, বাইরে যেতে চাই,
স্রোতের আঘাতে তবু কুটোর মতন ভেসে মরি-
আমার সমস্ত ক্ষত বিন্দু বিন্দু ঝরে যায় জলে ।

আমি যেখানেই যাই
ফিরে এসে
বৃত্তের ভেতরে কড়া নাড়ি !

কে আছ? ঈশ্বর? নারী?
নাকি আমারই আয়নার জোড়াতালি?
বৃত্তের পরিধি ক্রমে বড় হয় 
আরো বড়, আরো বড়, আরো ।

পরিচিতার সৌজন্যে

এই তীব্রদিন থেকে যত নিই, তত থেকে যায় ।
             ছোটো সিমলা ঘুরে যায়; শাদা রাস্তা রঙিন বাড়িতে
পোষা কুকুরের মতো গৃহিনীর উঠোণ নাচায় ।
             ঠিক বান্ধবী নয়; পরিচিতা; এক যুগ পরে দেখা এই ।-
দীর্ঘদেহ স্বামী, আর ফুলের মতন শিশু সাজানো বাগানে ;
             তারই জন্যে এত সব ? হতে পারে। সমস্ত সময়
এক বাঙালিনী তার উজ্জ্বল হাসিতে ঐ সমস্ত পাহাড়
             নতুন গানের মতো বেঁধে নিতে পেরেছে বলে কি
শুধু দিন তীব্র হয়, দ্যুতিখণ্ড উজ্জ্বল আবেগ
             সোজা প্রসপেক্টে গিয়ে সূর্যের ভেতরে করসায়?

আমি যতটুকু পারি, তার বেশি তখনো পারিনি, তবু যেই
             দমকা হাওয়ার টানে সমস্ত আড়াল একাকার,
পোড়-খাওয়া কলকাতা বুকের ভেতরে নিবে যায় ।



মেলা দেখাও

কোন জায়গায়, কোন কোন  জায়গায়
তুমি আছ? তুমি, মানে মানুষ ;
রেডিওতে কারা গাইছ দেহলীর সাধন-
বাউল, তুমি বাইরে এসে বাবু সাজো !

সাধন-ভজন ভালো, কিন্তু ডেরা কোথায়,
বাড়ি আসতে দেরি হল, পথে দেরি?
কোন জায়গায়, কোন কোন জায়গায়
তুমি আছ? ঘৃণা-ভালোবাসায় তৈরী? ভারি গড়ন?
কলকাতা বা কেঁদুলি, আমায় মেলা দেখাও, মেলা দেখাও

আমি টিকিট কিনে মানুষ দেখব ।


কলকাতা ও আমি

রাস্তায় দশটি লোক শুয়ে আছে ।
             আমি ল্যাম্পপোস্ট হয়ে দাঁড়াতে পারিনি ।
খুব বেশিক্ষন আমি আলো দিতে শিখিনি এখনো 
আমার নিজের কিছু অন্ধকার আছে,
             কিছু দ্বিধা, কিছু অসুবিধা ।
রাস্তায় দশটি লোক শুয়ে আছে ।
             আমি একাদশ ব্যক্তি ; কলকাতা,
                 শুতে জায়গা দাও ।

কবিতার জন্ম

আমি সব টের পাই !
আলিসায় একা কাক মুখে ভাঙা অন্ধকার নিয়ে
বসে আছে, তার ডানার ঝাপট
সোজা বুকে এসে লাগে ।

সে কি জানে, সে আমাকে একটু একটু করে
শব্দ ও ভাষার দিকে নিয়ে যায়?
এভাবে সংকেত করে সবকিছু-আমি লুফে নিই
যা কিছু খবর, বার্তা, প্রতিটি মূর্হুত জুড়ে
যা আমাকে রসদ পাঠিয়ে চলে আজীবন ।

কাক উড়ে যায়,আমি আমার কলম নিয়ে


             স্তব্ধ পাতার দিকে ঝুঁকে পড়ি একা ।

দেবমাল্য চক্রবর্তী

মা নিষাদ   ‘শয়তান, তুই নরকে যাবি পাপ-পুণ্যের জ্ঞান নেই তোর, শয়তান, তুই নির্ঘাৎ নরকে যাবি অভিশাপ দিচ্ছি তোকে, তুই নরকে যাবি’ দস্য...

ক্লিক করুন। পড়ান।