Saturday, May 5, 2018

একগুচ্ছ কবিতা : ওবায়েদ আকাশ





মুক্তি

আমার বিছানাসঙ্গীর গায়ের ওপর থেকে
চাদর সরিয়ে দেখিসে ওখানে নেই!
একটি প্রাপ্তবয়স্ক আত্মজীবনী পড়ে আছে

কে যেন আমার দীর্ঘদিনের পাঠাভ্যাসের সঙ্গে
শয্যাসঙ্গীর অনুপস্থিতির বিবাহ পরিয়ে দিল-

তারা যখন তুমুল সঙ্গমে ব্যস্তআমি আত্মজীবনীর
একটি একটি পাতা খুলছি আর
নতুন নতুন পাতা এসে ভারি করে তুলছে স্মৃতি-

তারা আমাকে সঙ্গমে আহ্বান করছে--আর
আমি তাদের মুক্তির কথা ভেবে
পৃষ্ঠাগুলো এলোমেলো ছিঁড়ে
            উন্মুক্ত উচ্ছ্বাসে উড়িয়ে দিচ্ছি

অভ্যাসবশত ভোরবেলা--আমাদের সন্তান যখন
            আমার গায়ের চাদর ধরে টান দিল--
দেখলআমাদের দু’জনের কেউই তখন
                        নেই ওখানে!

মনে মনে ভাবলামপ্রত্যেকের মুক্তির জন্য
কেউ-না-কেউ একজন থাকেই প্রান্তরে


হর্ষতরঙ্গ

হর্ষতরঙ্গতুমি নিবেদিতার জন্য এক টুকরো
জায়গাজমি রেখ

জানো যেঅসময়ে বজ্র-বিষয়ক মামলায়
তার চুলের গভীর দিয়ে ঢুকে পড়েছে রাষ্ট্রীয় শোষণ

এখন সে সমুদ্রকে বাজার আনিয়ে দেয়গভীর রাতে
তার কামনার পাশে উন্মুক্ত করে ব্যক্তিগত মহার্ঘ শরীর

নিবেদিতা বোঝে তার নিশ্বাসের ওপর
কত দ্রুত গজিয়ে উঠছে সারি সারি দালান সভ্যতা

অথচ তার জন্য একটি কামরাও বরাদ্দ নেইযেখানে সে
অন্তত নিজের শরীরটাকে খুলে
এক মুহূর্ত বিশ্রাম করিয়ে নিতে পারে!

আনন্দলহরীতুমি নিবেদিতার বুকের ওপর থেকে
একটিও আগাছা উপড়ে ফেলতে যেও না


বৃষ্টির জন্য

বৃষ্টির ওপর ঘোড়া চাপিয়ে
বিদ্যালয় ঘরে নিয়ে এলো বাবা

মায়ের উৎকণ্ঠা তখন
টিফিনের মাছগুলো ভিজে জলে নেমে গেলে
আজ অনাহারে থাকত ছেলেটা!

বাবা ভাবছেআর এমন হলে
মাছের ছেলেমেয়েগুলো
পুনর্বার ফিরে পেত তাদের বাবা-মায়ের ওম

এমন বৈপরীত্য সত্ত্বেও আজ
দীর্ঘকাল পর পেছনের জংধরা শাহী দরজাটা
বৃষ্টির জন্য খুলে দিল তারা  




রক্তের ধারা

মাছবাজারে যে মাছটির দরদাম নিয়ে
কথা কাটাকাটি হাতাহাতির দিকে যাচ্ছিল--
তার পাশের ডালা থেকে একটি কর্তিত কাতলের মাথা
আমার ব্যাগের ভেতর লাফিয়ে ঢুকে গেল

তখন মস্তকবিহীন কাতলের অবশিষ্ট দেহের দিকে তাকাতেই
আমার সমস্ত শরীর রক্তে লাল হয়ে গেল

কাতলের যিনি প্রকৃত ক্রেতা ছিলেন
মানিব্যাগ থেকে মূল্য পরিশোধ করে বললেন--

এ নিয়ে কিছু ভাববেন না হে
আজকাল মাছেরা যেভাবে রক্তপাত করতে শুরু করেছে
এভাবে চললে আপনি-আমি সবাই এমন রক্তে নেয়ে যাবো

আর তৎক্ষণাৎ বাজারের সকল মৎস্যবিক্রেতা যার যার রক্তের ধারা
আবিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে গেল

কেউ বলল: আমি সেন বংশজাতআমি পাল বংশোদ্ভূতআমি...

এবং দেখা গেলবাজারে যে ক’জন ক্রেতা ছিলেন
শুধু তারাই ছিলেন মীনবংশজাত

যারা নিজেরাই নিজেদের মাংস ভক্ষণ করতে
বাজারে এসে কথা কাটাকাটি থেকে রক্তারক্তি পর্যন্ত চলে যেতে পারে


চলে যাচ্ছ অজ্ঞাত দিকে

একবার যখন ডুবছহাত তোলো
অনেক বাতাস ঘসে শোঁ শোঁ শব্দ তুলে জানিয়ে দাও
আগুন নিয়ে তুমি শুধু অবাঞ্ছিত শব্দটুকু ফেলে রেখে
ফিরে যাচ্ছ হলুদ ধবল অজ্ঞাত অসুখের ভেতর

যত চাঞ্চল্য এখন বৃষ্টির মধ্যে ঘামিয়ে তুলেছে মাটি
শুকনো মুখে বসে আছে বাগানের বিধবা দোয়েল
এবং অনর্গল ইংরেজি বলে শহীদ মিনার কাঁপিয়ে দেবার আগে
শরীরে সংযোজিত হচ্ছে নতুন বয়স
যা তোমার বার্ধক্যের বিস্মৃতি থেকে ফিরিয়ে দেবে বাঁশি বাজানোর দিন

নির্জলা বলেছিলএইসব কালো কালো ফল
আঙুলের নিঃসঙ্গ দৈর্ঘ্যরে খোঁচায় ছিঁড়ে কেটে
রক্ত ঝরিয়ে যাচ্ছেমাটিতে এত আলতামিরা খুনসুটি
অভিন্ন শোকের মতো গড়িয়ে চলেছেকেউ নোটিস করছে
অন্তত দেখেশুনে একটি কার্বনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুনো জরুরি

তুমি বুদ্বুদ সরিয়ে দিলেঘাসের ওপর থেকে সন্তর্পণে জড়িয়ে নিলে
অন্তিম টাওয়েল! আর একবার ভাসতে চেয়ে দু’হাত ছিঁড়ে
ছুড়ে মারলে অনন্তর ভারাক্রান্ত স্বজনের দিকে। একবার শুধু
টগবগ করে উথলে উঠল রোদ। তোমার সকল প্রতিশোধ বুঝে
উঠবার আগে সমাহিত জলে পাড়ার শিশুরা খেলতে নেমে গেল

ওখানে কি গাছের পাতা পড়ে?
কিংবা রঙিন বেলুনে ফুঁ দিলে ভেসে ওঠে সন্তানের মুখ?


বর্ণ ও বৈশ্বায়ন

আর আমার জন্য বসে আছে ক্লান্ত কিছু লোক
তারা আমার লাশ বয়ে নিয়ে একটি মরচেধরা জাহাজের
                 নোঙরের অপেক্ষা করবে...
জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়বে জন্মান্ধ প্রবীণ নাবিক
                   খুচরো কিছু তুষার মানবী

এবার তারা আমাকে লিঙ্গান্তর করে
     একটি হিমাগারের দিকে নিয়ে যেতে চাইবে
            দরজায় বসিয়ে দেবে সমাজতন্ত্রের ঘোড়া
কেননা আমার তো লিঙ্গ ছিল না কোনোবরং
এ জাতীয় ব্যবচ্ছেদ বিষয়ে জমেছিল সহস্রাব্দের মেদ

আর আমার বর্ণ ও বৈশ্বায়ন নিয়ে
পৃথিবীতে পতিত রাজতন্ত্রের নায়কেরাযারা যারা
                      অন্যায্যই প্রশ্ন তুলেছিল
আর ঝুম ঝুম প্লাবনের তোড়ে ঝরে পড়ছিল
                   পৃথিবীতে স্বৈরতন্ত্রের নুন
অভাব্যই আমার মৃত্যুর ভেতর থেকে খসে পড়েছিল
                   নক্ষত্রের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা
কারো কারো আজন্মের লালিত কৃমিতেই তারা
বেদনাতাড়িত হয়ে ঝুলে পড়েছিল
                সরু সরু সুপুরিশাখায়

কারো কারো প্রসব যন্ত্রণার কথা মনে পড়ে

            -তারা আমার হাত ধরেছিল
            -বুকের মাংসের ভেতর গুঁজে দিয়েছিল
                     থেঁতলানো মুখ
এবার বৃষ্টির ভেতর তারা আমার সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে ভেবে
              জল থেকে তুলে এনেছিল প্রকাণ্ড কুমির
ঝলসানো পাঁজরের কাছে সঁপে দিয়েছিল
                   রক্তাক্ত থাবাআর
জাহাজের পাটাতনগুলো এক এক করে
                     খুলে যাচ্ছিল লবণাক্ত জলে

অথবা যে এক চিলতে চাঁদ
মুখের কার্নিশে বসেআমার অক্ষত লাবণ্যের দিকেই
                   ঝুঁকে পড়েছিলঅগত্যা
জন্মান্ধ প্রবীণ নাবিকচড়ে বসেছিল
                জাহাজের লিঙ্গের চূড়ায়
আমরা তুষারের ভেতরএকটি জাহাজের নোঙরের ভেতর
                একটি মাস্তুলের কথা কখনো বলিনি!

আমার জন্য ছুটে এসেছিল ক্লান্ত কিছু লোক
                   -তাহাদের ঘুমের প্রয়োজন ছিল
                   -তাহাদের মৃত্যুর প্রয়োজন ছিল
আমার লাশ বয়ে নিয়ে কেউ কেউ
                  রাজতন্ত্রের ক্লান্ত গাধাটির মতো
                   গড়িয়ে পড়ছিল তলে

ধনতন্ত্র আর সাম্রাজ্যবাদের তুষার রূপসীরা
আমাকে টেনে নিয়েছিল নিরন্তর প্রসব বেদনায় 


রূপনগর

রূপনগর আমার হাত থেকে একদিন কেড়ে নিয়ে গেছে চালতার ব্যাগ। আমার প্রিয় চালতাফুলযাকে বড় হতে দিয়ে একদিন ছ’টাকায় উঠে পড়ি এই নগরের ট্রেনেসঙ্গে ইলিশ পোড়ার ঘ্রাণকাগজী লেবুঅথৈ দীর্ঘশ্বাস... এই ফাঁকে মাটির হাঁড়িতে জলশিং মাছের ঝোলএই নিয়ে ট্রেনের কামরায় কামরায় কেউ গান ধরে দিলে ঝিলপাড় থেকে ডগাভাঙা দুবলার কষে কেউ কেউ ধুয়ে নেয় হৃদয়ের ক্ষত। আর তাতে বনমরিচবুনো বিছুটির মতো টগবগ করে ছুটে যায় ট্রেন উত্তরের দিকে। আর আমি দুধভরা গাভীর ওলান ভেবে দুই হাতে খুঁজে পাই পুরু ফ্রেমের তলে ফোলা ফোলা চোখের অসুখ। বাঁশবাগানঘাসফুলপ্রাচীন হালটের ঢালে বাতাবিলেবুর ফুলে এমন আষাঢ়ের দিনেএকদিন মৌমাছি তুলেছিল বৃষ্টির ভাষাঅথৈ সবুজ থেকে নুয়ে পড়া স্নেহের গভীরে বসে চালতাফুলক্রমে তারা ফিরে পায় বহুরঙ মানুষের রূপ।... রূপনগরএই প্রিয় অভিবাস মুখরতা কোলাহলে ছায়াহীন ভালবেসে বসে আছে অজস্র স্টেশন শেষে  



No comments:

Post a Comment

দেবমাল্য চক্রবর্তী

মা নিষাদ   ‘শয়তান, তুই নরকে যাবি পাপ-পুণ্যের জ্ঞান নেই তোর, শয়তান, তুই নির্ঘাৎ নরকে যাবি অভিশাপ দিচ্ছি তোকে, তুই নরকে যাবি’ দস্য...

ক্লিক করুন। পড়ান।