Friday, May 4, 2018

গল্প : মহেশ্বর মাজি




                               রঙ্গমঞ্চ
                        
(এক)
অমল গলা কাঁপিয়ে জোর করে বলে উঠল,...ব...ঐ...ঐ.শাখি।তুমি যেও না বৈশাখি।হৃদয়ের ঘরে যে অনেক কথা জমা হয়েছিল।...কত আশা নিয়ে এসেছিলাম।তোমাকে আমার প্রেমের উপবনে গান শোনাব বলে...সে আর হল না।
দিলীপদা মুখের গুলটা পিচ করে দাঁতের ফাঁকে বের করে ডানহাতের ইশারাই অমলকে থামিয়ে বলে উঠলেন,বৈশাখি,.. তুমি যেও না বৈশাখি।
এই পর্যন্ত গলাটা চড়া থাকবে।তারপর একপাঁক ঘুরে গিয়ে নজরটা ওডিয়েন্সের দিকে করে বাকি কথাটা আস্তে  আস্তে শেষ করতে হবে।
     ...আর একবার শুরু কর।প্রথম থেকে।
অরুন তুই দাঁড়া।বৈশাখির প্রক্সি।
অরুণ বলে উঠল,... বাড়ি থেকে আমাকে বাইরে আসতে দিচ্ছে না। পাঁকা দেখা হয়ে গেছে।মা,বাবা এক বুক আশা নিয়ে প্রতিনিয়ত আমার সুখের ঘর সাজানোর চেষ্টা করছে।...কী করে আমি তাদের সব স্বপ্নগুলোকে চুরমার করে স্বার্থপরের মত তোমার বুকে মাথা রাখতে আসবো...বলো?...আমি তাদের আশা,ভরশা।আমিই তাদের খুশির একমাত্র ঠিকানা।আমার দেওয়া আঘাতে ওদের বুকে চাপ,চাপ রক্ত উঠবে।...তুমি আমায় ক্ষমা করো অমল।আমি কথা রাখতে পারলাম না।
এইবার অমল শুরু করল,...ব..ঐ..ঐ শাখি...বৈশাখি...বৈশাখি
এতদূর বলা হয়েছে।
ততক্ষণে নারান খুড়ো হাতে লম্বা একখানা তৈলাক্ত বাঁশ নিয়ে দৌঁড়ে আর হরিমন্দিরের মার্বেল পাথরে ঢাঁই করে মারলেন।
আর একটু হলেই অমলের পাদুটো চিরদিনের মত ভেঙে বসে থাকত।
আপাতত মেঝের কম্পনেই অমলের বুকের রক্ত শুকিয়ে কাঠ।
উপস্থিত সকলেই বাকরুদ্ধ!
কিছুই বোঝা গেল না।
এত জোরে তো কালবৈশাখিও হাজির হয় না।আর অমল তো বেচারা শুধু বৈশাখিকেই ডাকছিল।
দিলীপদা গুলে দাঁত ঘষতে,ঘষতে থেমে গিয়েছেন।ধাতস্থ হতে তারও খানিক সময় লাগল।
আর একবার গুলটা পিচ করে ফেলে নারানখুড়োর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,খুড়ো বলি এটা কী রকম ভদ্রতা!!
...মজা পেয়েছ নাকি?..ইয়ার্কির একটা লিমিট থাকা উচিত!
তোমার মাথা কালো থেকে সাদা হয়ে গেল।এখনো বোধবুদ্ধির উদয় হল না।..লাঠিটা যদি ছেলেটার পা টায় পেয়ে যেত...কী অবস্থা হত একবার ভেবেছ?
নারানখুড়োর চোখ থেকে এখনো যেন আগুন বের হচ্ছে।সেইরকম তাকিয়ে আছেন।ধুতিখানা এখনো সেই লোঙটের মত করেই পরেন।গায়ে একটা ঢিলেঢালা গেঞ্জি।আর গলায় গামছাটা তার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আজো অব্দি দীর্ঘ তিরিশ বছর হল সারাক্ষণ ঝুলেই থাকে।
ষাটের কোটায় ঢুকেও মুখের একটা দাঁত খসতে দেননি।
দুর্বলতা একটাই ।গলার স্বরটা যতই চেষ্টা করুণ না কেন জোরে বের করতে পারেন না। জুয়ান বয়েসে গলায় একবার খৈ-এর সাথে গোটা কতক ধান গিলে ফেলেছিলেন।
সে এক কান্ড গেছে!!
..দুদিন পর হাসপাতালের ডাক্তার চেক করে তবে গলা ফোলা কমিয়ে ছিলেন।
এক সময় ব্যথাটাও চলে গেল।কিন্তু সেই ঘনঘনে আওয়াটা আর আগের মত বেরুল না।
...বয়স পড়ার সাথে, সাথে সেটা আরো ক্ষীণ হয়ে আসছে।
...সেইরকম ক্ষীণ কন্ঠে শিস টেনে,টেনে বলতে লাগলেন,...বলি এটা কী বাঁদরামি হচ্ছে শুনি!..এক ঠেঙানিতেই চব্বিশটা দাঁত ঝেড়ে দেব।
দিলীপদা তো খচে বোম।তবু সংযত রেখে বলে উঠলেন,...বাকি দাঁতগুলো কী তুমি তোমার শ্রাদ্ধ ভোজ খাওয়ানোর জন্য ছেড়ে দেবে?...আগে হলটা কী বলবে তো?
নারানখুড়ো দমবার পাত্র নন।আওয়াজটা বেরুলে এতক্ষণ গাঁ শুদ্ধ লোক বেরিয়ে পড়তেন।
রাতের বেলায় তার তান্ডব নৃত্য দেখতে।
শিস টানতে,টানতে আবার বলে উঠলেন,...আমাকে কী বকাছোদা ভেবিছিস তোরা?...আঁ!!...এই ভর রাতে বৈশাখি নামটা তুলে বার,বার কেন ডাকা শুনি?...নাতনির আমার দুদিন বাদে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা।নামটা শুনে বার,বার উপর থেকে উঠে আর নামে।...পড়াশুনো সব চুলোয় গেছে।জানলার পর্দা টেনে এখন শুধু রাতের বেলায় বার,বার নিজের নামটা শোনার আশায় বসে থাকে।
...কখন এই বেহায়াটা হরি মন্দিরের চাতালে উঠে বলবে...চ...ঐ...তালি!..একদম চলবে না।
ওই নাম নিয়ে রাত,বিরেতে ডাকা একদম চলবে না। যাত্রা করতে হয় কর।তবে আমার নাতনির নাম ধরে একদম ডাকা চলবে না।
এতক্ষণে সবাই ধাতস্থ হল।ব্যাপারখানা পরিস্কার বুঝতে পারল।
দিলীপদা পরিবেশটা হাল্কা করার জন্য একটু হেসে বলে উঠলেন,.. ও এই ব্যাপার!
পরীক্ষা আছে।তা তো আমরা সবাই জানি।সেইজন্যই তো রাত করে রিহার্সাল শুরু করি।..যাতে কেন্ডিডেটদের অসুবিধা না হয়।...আর সারা গাঁয়ে এইচ এস দেওয়ার মত আছেই বা কজন?...তোমার নাতনি  বোশেখি আর অধীরের মেয়ে মন্দা।এই তো দুজন।বাকি জনার্দনের ছেলেটা তো হোস্টেলে পড়ে।
...এই দুজনের জন্য কী আমরা এতবড় যাত্রার রিহার্সাল বন্ধ করে দেব?এটাও তো একটা পরীক্ষা।গাঁয়ের মান,সম্মানের।আজ অব্দি এই সিদাবাড়ি গ্রামের যাত্রাপালার বদনাম করতে কেউ পারেনি।...এদের এখন কাঁচা বয়স।অভিনয়ের বোঝেটা কী শুনি।তাই দুমাস ধরে দাঁড় করিয়ে না শেখালে তো আমাদেরই বদনাম হবে খুড়ো।...তুমি কী সেটা চাও?
নারানখুড়ো একই রকম গজগজ করতে,করতে বলে উঠলেন,... সে সব আমি বুঝি না বাপ।তোরা ওই নামটা তাহলে বাদ দিয়ে দে।তারপর যাত্রা কর।আমার তাতে কোন আপত্তি নেই।
---সেটাই বলো খুড়ো।নামটাই তোমার আপত্তি ...তাই তো?...আরে বাবা..ভৈরববাবু কী জানতেন...যে তুমি একদিন তোমার নাতনির নাম তার যাত্রাপালার নায়িকাকে রেখে দেবে?
...বোশেখির তখন জন্ম হয়নি।ভৈরববাবু তার আগেই পালাটা লিখে ফেলেছেন।এবার তুমিই বলো খুড়ো দোষটা কার?
নারানখুড়ো বুঝতে পারলেন এই বেটার সাথে কথায় তাল দেওয়া যাবে না। আজ পর্যন্ত গাঁয়ের কেউ তা পারেনি।
তাই কাচুমাচু গলায় বলে উঠলেন,...তাহলে এই ছোড়াকে ভাল করে বুঝিয়ে দে।...যেমন এত জোরে আওয়াজ না করে।
দিলীপদা মনে,মনে হিসেব কষে দেখলেন।তর্ক বাড়ালে আজ আর রিহার্সাল হবে না।
একটা দিন লস হওয়া মানে ছেলেগুলোর অনেক ক্ষতি।
তাদের ভাল,মন্দের সাথে নিজেদের মান,সম্মান জড়িয়ে আছে।
তাই শান্ত গলায় বলে উঠলেন, তুমি খুড়ো বাড়ি যাও।
বাকিটা আমি দেখছি ।
বুড়ো তবু শেষ বারের মত লাঠিটা আর একবার চাতালে ঠুকে বলে উঠলেন,.. তাই বোঝা ভাল করে।না হলে কিন্তু এবার ঠেঙাটা মাথার মাঝেয় পড়বে।
বাকি ছেলেগুলো এতক্ষণে মুখ চেপে ফিক ফিক করে হেসে উঠল।
হাসতে পারল না অমল।বেচারা বড্ড ভয় পেয়ে গিয়েছে।
মাধ্যমিক পরীক্ষার পর সেই যে গ্রাম ছেড়ে একবার হোস্টেলের দুনিয়ায় বন্দি হল।আজ বি.এড শেষ করে তবে একটু মুক্তি পেয়েছে।
তাই গ্রামে আসা।আর এসেই বন্ধুদের খপ্পরে পড়ল।তারা এবছর নতুন যাত্রা করছে।নায়কের রোলটা অমলকে নিতেই হবে।
অমল কোন বাহানাও মারতে পারল না। এস.এস.সির এখনো তারিখ ঘোষণা হয়নি।তাই আর না করতে পারল না। মা,বাবার তাকে নিয়ে বড় আশা।বার,বার বলেছিলেন,চাপ হলে নিস না। ওসব করার অনেক সময় আছে। আগে একটা চাকরী জুটে যাক।তারপর না হয় দেখবি।মানা করব না।
অমল নিজেও এক্সাইটেড ছিল।তাই বলে উঠল,কোচিং-এ তো ভর্তি হয়ে গেছি।অসুবিধা কিছু নেয়। মনটা ফ্রী থাকবে।
...এখন মাঝখান থেকে বুড়োর লাঠির ঘা আর ওই তার নাতনিটির কথা মনে করে কেমন যেন দমে গেল।
(দুই)
অমল সকালবেলায় সাইকেলটা অশোকদার সাইকেল সারার দোকানে ঠেসিয়ে বাস ধরে কোচিং ক্লাসে যায়।
ফেরার পথে খানিকটা অন্য মনস্ক হয়ে পড়ল।
পড়াশুনোর ব্যাপারে এতটা চিন্তিত নয়। সেদিনের ঘটনাটা নিয়েই সে ভাবছে।
তার মা,বাবার কানে কী করে কথাটা পৌঁছে গেছে কী জানি।
তার মা তো খচে গেছেন।তার ছেলের নামে সাদা গায়ে কাদা দাগা!!
তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি ব্যাপারটা।একবার তো কোমরে কাপড়ের খুট গুঁজে বেরিয়েই পড়েছিলেন।ওই বুড়োটাকে শায়েস্তা করতে।
তার নাতনিটি কী স্বর্গের কোন অপ্সরা নাকি?...যে তার ছেলে লাটায় খেয়ে রাত জেগে নাম ধরে চেঁচিয়ে বেড়াবে?...যত্তসব!!
অমল আর তার বাবা একসাথে আটকে ছিল বলেই রক্ষে।না হলে গ্রামজুড়ে একটা রণক্ষেত্র কান্ড বেঁধে যেত।
দলটা অমলের দিকে ভারি ছিল।তবুও তার মাকে আটকে রাখল।
ছেলে আর বাবা এক।কেচাল হোক,সেটা তাদের সহ্য হয় না।
কী দরকার?...কাদা ছুড়লে দু পক্ষেরই গা নোংরা হবে।তারপর আবার অমলের বাবা একজন পঞ্চায়েতের কর্মী।শেষে যদি দলাদলি কান্ড বেঁধে যায়...আর রক্ষে নেই।
অমল কিছুতেই মনে করতে পারছে না। ওই বৈশাখি নামক দাবানলটিকে।
একই গ্রামে বাস।চেনারই কথা।সে হলে কী হবে?...অমল কটা দিন গ্রামে ছিল যে উঠতি মেয়েদের খোঁজ পাবে?
...ওকে আবার গ্রামের বন্ধুরাও সমীহ করে চলে।তাই ওর সামনে মেয়েদের নিয়ে কেউ কথা তোলে না।তা হলে মুখে,মুখে খবর পেত।
ওর মা,বাবাকেও সকলে ভয় করে।অমলকে প্রথম থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা বন্ধ করতে বলেছেন।
তাই অমলের ইচ্ছে হলেও বৈশাখির কোন খবর কারু কাছ থেকে আগ বাড়িয়ে আদায় করতে পারেনি।
  একবার আগুনটাকে স্বচক্ষে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
অমল তার স্মৃতিশক্তির উপর জোর খাটিয়ে দেখল ওই নারানদাদুদের পাঁচিল ঘেষে একটা নড়া কুলের গাছ ছিল।
দু,এক সময় ইস্কুল ছুটির পর সেও বন্ধুদের সঙ্গে যেত কুল কুড়োতে।
স্বাদটা আজো জীভে লেগে আছে।
ঠিক তখনি একটা বিনুনি বাঁধা মেয়ে ফুলফিতা নাচিয়ে দৌঁড়ে আসত।
হাতে তার একটা সরু মত কঞ্চি থাকত।
তা দেখে সবাই লাফ,ঝাপ মেরে পালিয়ে যেত।
অমল শুধু পারত না। ওর আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত।চোখে একটা অপার মুগ্ধতা নিয়ে।খুব ভাল লাগত ওকে এইভাবে দেখতে।মায়ের কাপড়খানি সারা গায়ে জড়িয়ে একেবারে গৃহিনীর মত সাঁজে।ভারী লাগে দেখতে।অমল তাকিয়েই থাকত।
মেয়েটি সামনে এসে বলত,....এই হাঁদা ওভাবে কী দেখছিস রে?...দেব এক লাঠি!.. বুঝবি কেমন জ্বলন।
অমল ঘোর কাটিয়ে বলে ওঠে,এই তুই এত ছোট তবু সবাইকে তুই দিয়ে কেন ডাকিস রে?...বাড়ির কেউ তোকে মারে না?
...শুনে মেয়েটি আকাশ,বাতাস কাঁপিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠত,পাগলা কোথাকার!...মারবে কেন রে?...আমি তো মহারাণী।আমার আদেশ বাড়ির সকলে পালন করে।
...তার আগে জবাব দে।সবাই পালিয়ে গেল,আমার ভয়ে।আর তুই কেন দাঁড়িয়ে রইলি?
অমল দুঃখ করে বলে উঠত,আমি তো গাছে চড়তে পারি না রে।...ওরা পকেটে ভরে সবকটা কুল নিয়ে চলে গেল।আমি খেতেই পাইনি।আজ কত করে মাকে ফাঁকি দিয়ে এলাম....তোদের গাছে দুটো সুস্বাদু কুল খাব বলে।...না খেয়ে যায় কী করে বল?
মেয়েটি ফট করে জড়ানো কাপড়খানা একটানে ছুড়ে ফেলে বলে উঠত,..তুই একদম চিন্তা করবি না।দাঁড়া আমি পেড়ে আনছি। একটা ফিনফিনে ফ্রক পরে তরতর করে মগডালে উঠে গিয়ে জোর করে একটা ডাল ঝাঁকিয়ে দিয়ে নেমে পড়ত।
অমলের সবকটা পকেট ভরেও বেড়ে যেত।তখন হাতে ধরত।
মেয়েটি হেসে বলত,খুশি!
অমলের সেই সময় কী যে ভাল লাগত!..
....হঠাৎ অন্যমনস্কের ঘোরে ডানে,বামে করতে করতে দুম করে সাইকেল সমেত অমল রাস্তার ধারে একটা পলাশ ঝোপে পড়ে গেল।
আগের সাইকেলের আরোহী রে.রে করে দৌঁড়ে গেল।
অমল চোখ বুজেই বলতে লাগল,সরি...সরি..বোন।
মেয়েটি আর্ধেক তুলে হাতটা আবার ছেড়ে দিয়ে আগুন চোখে বলে উঠল,এই কে রে তোর বোন এখানে?...থাক উল্টে পড়ে।এসে তোর বোনই বাঁচাবে।...আমি চললাম।একে তো সাইড দিতে শেখেনি।...তার উপর বোনকে ডাকছে!...হাঁদারাম।
অমল ভাবতেই পারেনি।মেয়েটি ওকে তুলে আলগোছা ফেলে দেবে ।
প্রথমবার যা লেগেছিল।দ্বিতীয়বার তার থেকে আঘাতটা বেশিই পেল।
তাই কোমরে হাত দিয়ে কোনরকমে ঝেড়ে,ঝুড়ে উঠল।
উঠে চারিপাশে তাকিয়ে দেখল।মেয়েটিকে দেখা গেল না। সাইকেল হাঁকিয়ে চলে গেছে।
...পৃথিবীতে এমন মেয়েও তাহলে আছে।যাকে বোন বললে খচে যায়।
তখনি অমলের মস্তিকে একটা কথা বম করে আঘাত হানল।
---হাঁদারাম
কথাটা একদম চেনা।এই মেয়েই সেই ছোট্ট নারানদাদুদের বাড়ির মহারাণী!!
...তবে কী এই সেই বৈশাখি??
(তিন)
দিলীপদা আজ সত্যি সত্যিই রেগে গেছেন।তাই জোর গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,... একি রে অমল!...আজ তোর হয়েছেটা কী?...বার,বার পাঠ ভুল করছিস?
মা,বাবা কী পাত্রী দেখছে নাকি?...এত চিন্তা করছিস যে!...আর বার,বার তোকে বলা হচ্ছে এদিকে তাকাবি।এদিকটা হল দর্শকের জায়গা।..তবু সেই বাম দিকেই ঘুরে যাচ্ছিস কেন?
.....না,সেদিনের নারানখুড়োর লাঠির শব্দটা আজো ভুলতে পারিসনি?চিন্তা নেয়। ও আর আসবে না। নুনিকে বলে দিয়েছি।এখন ওই তার বাপকে সামলাবে।
চল..এবার শুরু কর।...এই অরুণ দাঁড়িয়ে পড়।বৈশাখির মা কমলা হাতে প্রসাদের থালা নিয়ে প্রবেশ করল।
অরুণ বলা শুরু করল,...এই শুনছো..শুনছো এদিকে আমি.. আমি বৈশাখির মা বলছি।কমলা।
অমল না চেনার ভান করে বলে উঠল,.. বৈশাখি!! কে বৈশাখি? আমি তো আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।
অরুণ বলে উঠল,আমরা বৈশাখির সুখ কিনতে চেয়েছিলাম বাবা।ঈশ্বর তাই ওকে আজ অনেক সুখে রেখেছেন।আজ আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে।... হে বাঙালির ঘরে যত দায়িত্ববান মা বাবার দল।আপনারা আর দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে কন্যাদের চোখে সুখের কালো ফিতে বেঁধে আভিজাত্যের রাজপ্রাসাদে ছেড়ে আসবেন না।
....চোখ খুললেই সেই প্রাসাদের নগ্ন,বীভৎস রূপ দেখে আপনার তিলে,তিলে গড়া সেই মেয়েটির দুচোখে কালো বিভীষিকা নেমে আসবে।...হ্যাঁ... হ্যাঁ.. আমি ঠিক বলছি।
সবাই মগ্ন হয়ে আছে আপাতত কমলার কথায়।অরুণ ভালোই প্রক্সিগুলো টানে।নিজে জোকারের রোল ছাড়া করে না। দর্শকদের মাতিয়ে রাখে।
অমলের মনযোগ আজ আর পাঠে একদম নেয়।
বৈশাখি আজ জানলার পর্দাটা দুবার খুলেছে।একবার আলোটা জ্বেলেছিল।তবু তাকে ঠিকমত দেখা গেল না।
আজ সকালেও সাইকেল দুর্ঘটনায় দেখা পায়নি।
...মনের ভিতরটা বড্ড উসখুস করছে সেই ছোট্ট বেলার বিনুনি ঝোলা গেছো মেয়েটার ডাগর মুখখানা একটি বার দেখার জন্য। কথা যে পাল্টেনি।সেটা সকালের এক্সিডেন্টেই বুঝে গেছে।
...রূপ তো আর সেই তেমনটি থাকবে না।অমলের পরিস্কার মনে আছে।
ওর ডানপাশে একটা দাঁত অল্প মত বেরিয়ে থাকত।হাসলে বড্ড ভাল লাগত।আজো কী দাঁতটা আছে?না কোন ডেন্টিস্টকে দেখিয়ে সারিয়ে নিয়েছে?
দিলীপদার কথায় অমল চমকে উঠল,কী করছিস কী ?কখন থেকে এত জোরে চেঁচাচ্ছি শুনতে পাসনি?
...তোর তো পাঠগুলো মুখস্ত হয়ে গেছে।তবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে কেন আছিস?
অমলের মনটা খারাপ হয়ে গেল।
তাই আস্তে করে বলে উঠল,আমার আজ শরীরটা ভাল ঠেকছে না।
তাই বাড়ি যাচ্ছি।কাল তখন আসব।
দিলীপদা বলে উঠলেন,সেই ভাল।
অমলের উদ্দেশ্য অন্যরকম।বৈশাখি ঝোলা বারান্দায় এসেছে।অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তাদের রিহার্সাল দেখছে।এই সুযোগ কথা বলার।ওখানটা একদম ফাঁকা এবং অন্ধকার।কেউ তাকে দেখতে পাবে না।
অমল পিছনটা ভাল করে দেখে আস্তে করে বৈশাখির উদ্দেশ্যে বলে উঠল,এই দেঁতো।শোন।
বৈশাখি কান পেতেই ছিল।অমলের হাব,ভাব অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিল।সে যে তার সঙ্গে কথা বলতে চায়।বোঝায় যাচ্ছিল।ওকে ওইভাবে বেরিয়ে আস্তে দেখে,সেও আন্দাজ করেছিল।
বেটা সুযোগ খোঁজার তালে দিলীপদাকে মিথ্যে ঢিল মেরেছে।
তাই ডাক পেয়ে সেও বলে উঠল,এই হাঁদা তোর কমরটা ভাঙেনি তো?...আমি অবশ্য ভাঙার জন্যই ধাক্কাটা লাগিয়ে ছিলাম।
অমল বলে উঠল,বুঝেছি।কাল তোদের স্কুলের পিছনে ফুটবল মাঠে দশটার সময় দেখা কর।কথা আছে।
বৈশাখি বলে উঠল,বল গুতো খাবি? তাহলে?
ততক্ষণে, বৈশাখির বাবা উঠে এসেছেন,দিনরাত পড়াশুনো করে মাথাটা খারাপ করে ফেললি দেখছি।এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হাওয়ার সঙ্গে গুতোগুতি খেলছিস?
...কালকেই একবার তোকে ডাক্তার দেখিয়ে আনতে হবে।
চল নিচে...শুয়ে পড় গিয়ে।
অমলের তো দম বন্ধ হয়ে এসেছিল।একদম চুপচাপ পাথরের মত করে অন্ধকারে থম মেরে আছে।বৈশাখির পায়ের শব্দ শোনা গেলেও আর একজোড়া পা এখনো ব্যালকনির অন্ধকারটায় দাঁড়িয়ে আছে।অমল চুপটি করে বসে পড়ল।উঠলেই শব্দ পাবে।শব্দ পেলে,ধরা পড়তেও সময় লাগবে না। হয়ত দিলীপদাই এসে প্রথম হাতটা ধরবেন।
মিনিট দুই পরেই অমল পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারল।
গরম,গরম জলের ধারা যখন তাকে চান করিয়ে দিল।
উষ্ণ প্রস্রবণ শেষ হতেই গলাটা একবার ভাল করে ঝেড়ে বৈশাখির পিতৃদেব অন্ধকার বারান্দায় নিজেকে সামলে কেটে পড়লেন।
এদিকে অমল বেচারা জুত করে যে একবার বমি করবে তারও উপায় নেয়।
সব তার কপাল!!
(চার)
অমলের ডানহাতের তালুতে একটা সজোরে তালি মেরে সারা শরীর দুলিয়ে বৈশাখি হো..হো শব্দ করে হাসতে লাগল।
অমল সেই ফাঁকে তার সেই কিশোর বেলায় দেখা পুচকে মেয়েটাকে এখনকার সাথে একবার ভাল করে মিলিয়ে নিচ্ছে।
দাঁতটা এখনো তার নিজের জায়গাতেই আছে।
চুলগুলো লম্বা হয়েছে।তবে মুখটাকে মেলান যাচ্ছে না। চোখদুটোর চাউনি আজো পাল্টায়নি।
তখনো কাজল মাখত..এখনো মাখে।
  বৈশাখি হঠাৎ করে হাসি থামিয়ে বলে উঠল, এই শোন আবার ভাল,টাল বেসে ফেলিস নি তো?...তাহলে আজকেই শেষ দেখা ।
অমল বলে উঠল, আসলে তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল।
---তাহলে আগে কেন দেখিসনি?...তুই হোস্টেল থেকে ফিরতিস।তখন কই একবারো তো খবর নিসনি।
---তখন তো আর তোর দাদুর লাঠির ঘা আমার পায়ের কাছে পড়েনি।....তোর নামটা শুনেই সেই ছোটবেলার কুল খাওয়ার কথা খুব মনে পড়ে গেল।তাই একবার দেখতে ইচ্ছে হল।
---আর ভুলেও কোনদিন রাতের বেলায় ওভাবে অন্ধকারে দাঁড়াস না।... এটা ইন্ডিয়া ...মনে রাখিস।
---মাথা খারাপ!!
---হ্যাঁ রে তুই তাহলে বিয়ে কখন করবি?
---আগে একটা চাকরী তো জুটুক কপালে।
---আমিও ভাবছি... আগে চাকরী করব।তারপর বিয়ে।মা,বাবাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না। ওদের ওই এক বুলি।
চাকরী করে তুই করবিটা কী?...জামাই এতবড় ব্যবসায়ী ।ওর টাকায় কে খায়!..তারপর আবার তোকে কষ্ট করে চাকরী করার কী দরকার?
অমল অবাক হল।
বলে উঠল,দাঁড়া..দাঁড়া।এক মিনিট।জামাই মানে?....তোর কী বিয়ে হয়ে গেছে?
বৈশাখির চঞ্চল চোখদুটো শান্ত হয়ে গেল।মনে হল ভারি হয়ে আসছে।
ঠোঁটদুটো একটু কাঁপল।
...আমার একদম এ বিয়েতে ইচ্ছে নেই।সুশান্তর বয়স বত্রিশ ।আমার আপত্তি সেখানেও নেই। আমি চাই নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে।তারপর যদি পঁয়ত্রিশ বছরের ছেলেকেও বিয়ে করতে হয়।রাজি আছি।ওর, বড় মত একটা নিজস্ব নার্সিং হোম ছাড়া দুটো স্টেশনারী দোকান আছে।সুশান্ত তার বাবার একমাত্র ছেলে।এই মাস কয়েক আগে আশির্বাদ করে গেছেন।
কী করব আমি ভেবে পাচ্ছি না।পরীক্ষাটা চুকে গেলেই চারহাত এক করে দেবে।
সেইজন্যই তো দাদু সেদিন রেগে গেছিল।...কী করব আমি?...পড়তেও ইচ্ছে যাচ্ছে না। খালি ভাবছি।কী হবে ভাল রেজাল্ট করে?..কোন মূল্যই তো থাকবে না।
..... সেদিন বার,বার তোর ডাকটা আমাকে পাগল করে দিয়েছিল। সারাক্ষণ ভাবছিলাম...কে যেন আমাকে অন্তরের ঘর থেকে হাতছানি দিয়ে প্রাণের ঘরে ডাকছে।সেই ডাকে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলাম।
...তুই বিশ্বাস কর।আমার একবারো মনে হয়নি তুই অভিনয় করছিস।
পরে আমি নিজেই নিজেকে বোঝালাম।স্বপ্ন..শুধু স্বপ্নের মত।তা কোনদিন বাস্তবের সাথে মেলে না।
ছোট্টবেলার সেই মহারাণীর দুচোখে প্লাবন দেখে অমল ওঠে দাঁড়াল।
চোখদুটো তারো ভিজে এসেছে।
তাই অশ্রুকটা আড়ালে ফেলে বলে উঠল,দুঃখ পাস নারে!
বৈশাখি বলে উঠল,আমার বড্ড ভয় করছে রে অমল।শেষে তোদের যাত্রাপালার বৈশাখির মত আমারো করুণ পরিণতি না হয়!
..মা,বাবা সুখের মোহে অন্ধ হয়ে গেছে। আমি ওসব সুখ বিন্দুমাত্র আশা করিনি অমল।আমি চাই মুক্তির আনন্দ পেতে।হাত,পা ছড়িয়ে নিজের মত করে জীবনের প্রতি ছন্দে একটু নাচতে।নিজে রোজগার করতে।মেয়ে বলে কী আমি এটুকুও স্বপ্ন দেখতে পারি না বল?
অমল গলাটাকে ঝেড়ে বলে উঠল,এসব প্রশ্ন আমাকে কেন করছিস?আমি আর কী করব বল?
বৈশাখি উঠে দাঁড়াল।নিজের চোখ, মুখ মুছে বলে উঠল,পারবি আমার হাত ধরে এই গন্ডি থেকে আমাকে চিরদিনের মত মুক্ত করতে?
বিয়ে করতে বাধ্য করব না। নিজের পছন্দ মত করিস।
অমল কোন উত্তর দিতে পারল না। পলাশের রাঙা ফুলগুলো লম্বা,লম্বা ফল হয়ে ঝুলছে।
পলাশের যত গর্ব তার ফুলেই!
তখন চারিদিকে তাকে নিয়ে কত মাতামাতি!তারপর আর কেউ খোঁজ রাখে না। জীবনটা এরকমই!!
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফস করে ছেড়ে বৈশাখি বলে উঠল,....না থাক।তোর মা,বাবা অনেক আশা নিয়ে তোর দিকে চেয়ে বসে আছেন। তাদেরকে দুঃখ দিয়ে তুইও কোনদিন সুখী হতে পারবি না।
অমল সব বুঝতে পারছে।বৈশাখি মিথ্যে বলেনি।
সে কিছুতেই পারবে না.... মা,বাবার চেনা স্বপ্নগুলোকে দু পায়ে মাড়িয়ে বৈশাখির হাত ধরে অজানার অন্ধকার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে।
তিল,তিল করে জমা করা মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্নগুলো বড় ভয় দেখায়।মনটাকে পোষা কুকুরের মত অনুগত করে ফেলে।তাই সে বিদ্রোহ করলেও একটা পা পর্যন্ত ওঠাতে পারবে না।
দুজনেই বুকের উপর কয়েক মন পাথর চাপা রেখে কয়েক পা এগিয়েই আর আলাদা হয়ে গেল।
....এরপর দুজনের কবে দেখা হবে কেউ জানে না।
খেলার মাঠ পেরিয়ে মোড়ের ব্যস্ততায় মিশে গেল অমল।তবু যেন কিছুতেই নিজেকে বোঝাতে পারছে না।
সেদিনের ছোট্ট বিনুনি বাঁধা মেয়েটির কথাটা, মনের চার দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল,...আমি তো রাজরাণী।
আজ সে কত অসহায়!
...সেও তো রাজা হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। মধ্যবিত্তরা কোনদিন রাজা বা রাণী হয় না।শুধু মঞ্চে ভাল মত তাদের অভিনয় করতে পারে।একদম দক্ষ অভিনেতার মত।বিশাল এই পৃথিবীর বিচিত্র রঙ্গমঞ্চে।

No comments:

Post a Comment

দেবমাল্য চক্রবর্তী

মা নিষাদ   ‘শয়তান, তুই নরকে যাবি পাপ-পুণ্যের জ্ঞান নেই তোর, শয়তান, তুই নির্ঘাৎ নরকে যাবি অভিশাপ দিচ্ছি তোকে, তুই নরকে যাবি’ দস্য...

ক্লিক করুন। পড়ান।