Saturday, May 5, 2018

ধারাবাহিক গদ্য: দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়




ভালোবাসাগুলো সেলিব্রিটি হয়ে...যায়নি


বর্ষার রাত।মা রান্না ঘরে গুনগুন করছেন। রেডিও চলছে। ভেজা হাওয়ায় পর্দা উথাল-পাথাল। হেমন্ত গাইছেন রেডিওতে। এই দৃশ্য আমার আজন্ম শেকড়। যত দূরেই যাই, এ ছবি আমায় পিছুটানে। আমি ফিরে আসি, আমার শহরে। কলকাতায়। অনেক অভিযোগের পরেও। কিছু তেমন পাবোনা, জেনেও। বারবার।লিখতে বসি পড়ন্ত আলোয়। আবার... 

আজন্ম মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের যে একটি ইমেজের কথা একটু আগে বললাম, তাকে সুকৌশলে ভেঙে ফেলার কাজ শেষ হয়েছে।এ মুহূর্তে সমুদ্রের তলপেটের শুন্যতা আমার শহরে। বড় ধরনের কোন চিন্তা নেই।ছেলেমেয়েরা অন্য শহরে কোনোক্রমে পালাচ্ছে। এক ধরনের চন্ডীমন্ডপ, যেখানে মরারা রোজ নৈশভোজ চালাচ্ছে।তারাই সিনেমা, থিয়েটার, কবিতা, গান, পরিবার, রাষ্ট্র। ৩০ বছরের পুরোনো চিন্তা। তারসাথে, ইন্সিকিওরিটি, ইগো। কেমন, পরমাণু বোমা পড়েছে বলে মনে হয় এখানে।কারোর আর কোনো দায় নেই মরে যাওয়া ছাড়া।তাই পলিটিক্যলি কারেক্ট সকলে। ছেলেমেয়েদের শরীরে গভীর অসুখের উল্কি।তারা এখুনি কোওয়েস্ট বা এক্রোপলিসে ঢুকে গেল। আর, বড়রা অফিস যাচ্ছে। ঝড় আসছে একটা...

এই রোগের কথা কি বলা হচ্ছে শিল্পে? উত্তর, “না”। আবার “হ্যাঁ”। ইন্ডাস্ট্রিশাসিত যে শিল্প, তাতে এ রোগ অনুপস্থিত। গানে, সিনেমায়, থিয়েটারে এক ধরনের বালক ব্রম্ভচারী কেস। মরা দেহে আতর ঢেলে ব্যবসা। বুড়ো মরারা আবার লবি করছে। সেখানে বাচ্চা মরাদের তুলে আনছে।এভাবে লাশের পাহাড় জমা হচ্ছে পোস্টারে। ঝলমল করছে। গন্ধ বেরচ্ছে। তীব্র গন্ধ। বলা হচ্ছে, বাচ্চা মরারা যে মরা শিল্প তৈরি করছে, তাই সমকাল। অথবা, আকাল। 
তো, আকালের সন্ধানে বেরলে, পাওয়া যেতে পারে তৌফিকের ইন্টস্টলেশন, সাত্যকি’র গান, কসা’র ছবি, মোজোর ফিল্ম, জয়রাজের নাটক, রাজা আলমের সিনেমা। মিলতে পারে, প্রদীপ্তর ছবি বা বছর কয়েক আগের “স্থানীয় সংবাদ”। এই অধমো চেষ্টায় তাঁর লেখায়, ভিডিওতে। এ সব চেষ্টার সাথে মিল পাই বিশোযুদ্ধেত্তর জার্মানির ভাল্টার বেনিয়ামিনের আরকেড প্রোজেক্টের।বড়ো তুলনা। কিন্তু তুলনা। ভাঙাচোরা টুকড়ো জুড়ে চেষ্টা চলছে সময়ের কোলাজ আঁকার। 

সুমন মজুমদারের ছবি ফেডিং ক্লাউডস। যে শহর ছাতে দাঁড়ালে কলোনি পেরিয়ে অক্রোপোলিসের রঙিন সমুদ্র, তাঁর গল্প বলে। বলে, সেই চৌকো বাক্সের ভেতরের তিনটি একা মানুষের গল্প। রাজা আলম বলেন, কলেজ পাশ করার পর কিছু না করা এক প্রাক্তন ছাত্রের জীবনের কথা। ফাঁকতালে ধুকে পড়ে সময়। অন্য কলকাতা। যে কলকাতার কথা আমরা সচরাচর দেখতে পাইনা। এ-সব ছবিতে যে ধূসর সময়, তাঁর কথাই কিছু আগে বলার চেষ্টা করছিলাম। ইন্ডাস্ট্রির বাইরে এভাবেই বারবার ধরা পড়ছে সময়। প্রথম ছবিটি তৈরি হয়েছে সত্যজিৎ রায় ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ফিল্ম স্কুলে। দ্বিতীয়টি, যাদবপুরের ফিল্ম স্টাডিজের প্রাক্তন ছাত্রের। কোথাও দেখানোর ব্যবস্থা নেই এ সব ছবি। নেই কোনো প্রযোজকও। 

আমি এই শিল্প নিয়ে লিখছি, কারণ, আমার মতে, এগুলি ঝরা সময়ের গান। টুকরো টুকরো কোলাজ জুড়ে গড়ে উঠতে পারে, ফুটো সময়ের চালচিত্র। সে দৃশ্যে, যাদবপুরের রাস্তায় নেমে পারফমর করতে থাকেন তৌফিক। তাঁর বিষয় নেই কোনো।বা, বিষয়হীনতাই বিষয়। আসলে, আধুনিক শিল্পে আর নতুন করে কিছু বলার নেই। এ কথা বুঝে যাওয়ার সময় এসেছে। বরং বর্তমান শিল্পকলা অনেক বেশি এক্সপেরিয়েন্স ধর্মী। যা হেযে যাওয়া সময়কে শক দেয়। মরার শরীর ধরমর করে ওঠে। এখন আর এপিক নামিয়ে লাভ নেই। ব্যগেজ-ঝোলা নামানোর সময় এটা। ভোলা চলেছে রিসাইকেলে।তাতে, পাহাড়-সমুদ্রের অনুভব আঁকছে কষাদা। আঁকছে ভালোবেসে শুধু। নগর-সমাজ-বেশ্যাপট্টি-সৈকত। শেকড়। শেকড়। আপাত ভাবে জমি হারানো প্রজন্ম পায় শেকড়। সাত্যকি গান ধরেন। বাজেশিবপুরে জমায়েত করেন জয়রাজ।এইট-বির গলি থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসছেন প্রদীপ্ত। বলছেন, রাস্তাই মঞ্চ আমার...

আমিও এ সব দেখে, হারাতে-হারাতেও ভরসা পাই। বলে উঠি, ভালোবাসাগুলো সেলিব্রিটি হয়ে যায়নি তা হলে...

No comments:

Post a Comment

দেবমাল্য চক্রবর্তী

মা নিষাদ   ‘শয়তান, তুই নরকে যাবি পাপ-পুণ্যের জ্ঞান নেই তোর, শয়তান, তুই নির্ঘাৎ নরকে যাবি অভিশাপ দিচ্ছি তোকে, তুই নরকে যাবি’ দস্য...

ক্লিক করুন। পড়ান।