স্টকার-এর সঙ্গী তারকোভস্কি
তার সৃষ্টির সাথে
নিজেকে, নিজের অনুভব কে, সেই অনুভবের প্রকাশ কে মিলিয়ে দেওয়ার জন্যে এই যা কিছু
সৃষ্টির আয়োজন আমাদের।
গত সংখ্যার
আবহমান’এ তারকোভস্কি কে নিয়ে যে লেখাটা লিখেছিলাম তার শেষ বাক্যটি ছিল এরকম। তারপর
প্রায় এক মাস চলে গেছে আর প্রায় প্রতিদিনই মনে হয়েছে, আসলে এটি সমাপ্তি বাক্য নয়,
এটিই শুরুর কথা, তারকোভস্কির মত কোনও শিল্পীর সমগ্র সৃষ্টির উত্তাপের কাছাকাছি
আসার জন্য।
মনে করুন, স্টকার
ছবিটার কথা। স্টকার এমন একজন মানুষ যে কৌতূহলী মানুষদের এমন একটা জায়গায় নিয়ে যায়
যেটাকে অঞ্চলের লোকে zone নামে চেনে। zone একটা রহস্যময় স্পেস। সেখানে কি আছে
কেউ জানেনা। লোককথা শোনা যায় বহুদিন আগে একটা প্রকান্ড উল্কা এসে পড়েছিল ওই
জায়গায়। ছবির শুরুতেই জানানো হয়েছে ওই
উল্কাপাতের ফলে যে বিশাল খাদ তৈরি হয়েছিল সেটা এখন আগাছা, অচেনা উদ্ভিদ, গাছপালা,
আর কুয়াশায় ঘেরা। আলো অন্ধকারের চির রহস্য তাকে ঢেকে রাখে। সাধারণ মানুষের প্রবেশ
নিষেধ সেখানে। সেনাবাহিনী আর কাঁটাতার দিয়ে ওই স্পেসটা ঘেরা থাকে সবসময়। যাওয়ার
পথও দূর্গম। জল, কাদা, পরিত্যক্ত রেল ইয়ার্ড, ভাঙা রেল লাইন, ঝাপসা অন্ধকার, ধূলো
আর পুরনো ক্ষয়ে যাওয়া ভাঙাচোরা মেশিন আর ফেলে দেওয়া যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে
থাকে চারপাশে। লোকে বিশ্বাস করে ওই স্পেস এ কৌতূহলী অনেকেই যাওয়ার চেষ্টা করলেও
শেষ অবধি কেউ পৌঁছতে পারেনা। আর যদিও কখনো পারে তাহলে আর সেখান থেকে ফিরে আসে না।
দু একজনের কথা তার জানে যারা গিয়ে ফিরে এসেছিল। মানুষের বিশ্বাস ওই জায়গায় পৌঁছে
মানুষ যা কামনা করে তাই পায়। লোকে বলে যারা শেষ অবধি গিয়ে ফিরে এসেছিল তাদের মধ্যে
একজন কিছুদিনের মধ্যেই বিশাল ধনী হয়ে উঠেছিল। কিভাবে এটা হয়েছিল কেউ জানেনা।
কিন্তু তার কিছুদিন পরেই লোকটি আত্মহত্যা করে। অন্য আর একজন পরে উন্মাদ হয়ে যায়।
একদিকে রহস্যময়
এক স্পেস যা দুর্নিবার টানে কোনও কোনও মানুষকে। আর অন্য দিকে এক বেদনা মলিন,
ভাগ্যতাড়িত, ছেঁড়াখোঁড়া এক জীবন। লোকে তাকে বলে স্টকার। তার ঘরে পঙ্গু অসুস্থ
কন্যা, অসুখী অসহায় স্ত্রী, ভাঙাচোরা ঘর। zone কেন তাকে এভাবে সারাক্ষণ টানে, সে নিজেও জানেনা। অন্য
মানুষদের মত সেও কি সুখি হবে বলে, কোনও মনষ্কামনা পূর্ণ হবে বলে বারবার ওই জায়গায়
ফিরে যায়?
অন্যদের কথা
আলাদা। স্টকার নিজে জানে এটা কারণ নয়। এমন কি সে নিজে অন্যদের সেখানে পথ দেখিয়ে
নিয়ে গেলেও যেটাকে সে বলে ‘রুম’ বা সেই ঘর, যেখানে মানুষের মনষ্কামনা সফল হয়,
সেখানে সে নিজে কখনও ঢোকে না। সে তার সহযাত্রী, লেখক আর বিজ্ঞানী কে বলে ঘরে
প্রবেশ করতে। যদিও শেষ অবধি তারা সেখানে যায়না।
“A la fin tu es las de ce monde
ancien.” আপোলনীয়ের এর তাঁর কবিতা Zone শুরু করেন এই ভাবে।
বাংলা অনুবাদে, ‘আর শেষ অবধি তোমাকে ক্লান্ত করে এই প্রাচীন পৃথিবী’। জোন কবিতাটি
কোনও নির্দিষ্ট ভৌগলিক স্থানের কথা বলেনা। কোনও বিশেষ সময়ের কথাও বলেনা। শুধু
ইতিহাসের এক নিয়মবিহীন অনির্দেশ্য ভ্রমণের কথা বলে। পারী শহরের রাস্তা কাফে সেখানে
যেমন আসে তেমনি তার বাইরের রিফ্যুজি বস্তি, শরণার্থী শিবির, মানুষের ঘরবাড়ি
প্রতিবেশ, সব কিছুকেই স্পর্শ করে যায়। এক সূর্যোদয় থেকে আর এক সূর্যোদয় অবধি তার
পরিভ্রমণ। বিচ্ছিন্ন এক বিশ্বে একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করে ফিরে আসে। তারকোভস্কির
স্টকার ছবিটিও একটি বৃত্তাকার সময়ের কথা বলে। যার শুরু বিদ্ধস্ত ক্ষয়ে যাওয়া এক
জনপদ। ভাঙ্গাচোরা কয়েকটা জীবন। আর তার থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজা।
কিন্তু যদি শুধু এটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতেন তারকোভস্কি
তার সমগ্র সৃষ্টিকে তাহলে হয়ত বারবার এভাবে ফিরে আসার দরকার পড়ত না আমাদের তার
কাছে।
সহবাস, মনে হয়, আসলে এক ব্যক্তিগত অসুখের মতন। কিসের সাথে
সহবাস? কার সাথে সহবাস? ধরা যাক আপনি এক আদিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তরের সামনে দাঁড়িয়ে
আছেন। হয়ত কোনও সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয়ের মুহূর্তে। অথবা হয়ত কোন বিশাল পর্বত
শৃঙ্গের সামনে। হয়ত এক তুমুল জলপ্লাবনের দৃশ্যে অভিভূত হয়ে আছেন আপনি। আর সেই
আত্মবিস্মৃত মুহূর্তে, ওই বিশালতার দিকে তাকিয়ে,
যে অনুভূতি আপনার মধ্যে তোলপাড় করে জেগে উঠছে সেটা এই যে, এমন একটা কথা দাও
আমায়, এমন একটা সুর দাও, যা দিয়ে তোমার এই রহ্যময় বিশালতার সঙ্গী হতে পারি। এক হতে
পারি। মিলে যেতে পারি তোমার সাথে। কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব কেউ জানে না। স্টকার
শুধু এটুকু জেনেছে যে সেখানে পৌঁছতে গেলে তোমাকে অসীম বেদনা সহ্য করতে হবে।
জোন এমন এক স্পেস যেখানে ফুল ফোটে কিন্তু সুবাস ছড়ায় না।
যেখানে অদ্ভুত এক নীরবতা বিরাজ করে। একটা পাতাও কাঁপেনা। যতক্ষণ না কেউ তাকে
খুঁজতে খুঁজতে সেখানে এসে পৌঁছয়। যেন এক ফসিল ভুখন্ড। গতি ফিরে পায় তখনই যখন কেউ
আবার তার মধ্যে প্রবেশ করে। কিন্তু প্রবেশ পথ শুধু দুরূহ নয়, প্রায় দুঃসাধ্য। সব
কিছু ছাড়তে হবে সেখানে পৌঁছতে গেলে। আর তারপরেও সেই জায়গা আদৌ আছে কি না তাও জানা
যাবেনা।
স্টকার এর একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। যেখানে বিজ্ঞানী আর
লেখক তাদের নিজস্ব কারণেই জোন এর সেই ঘরে ঢোকার পথে থেমে যায়। বিজ্ঞানী মনে করে
অন্য দুজন তাকে বাধা দিয়েছে। স্টকার তাকে বলে, তোমার ভয় তোমাকে বাধা দিয়েছে। বলে, zone একটা
গোলোকধাঁধা। জটীল। অদৃশ্য ফাঁদ পাতা সব জায়গায়। বিপজ্জনক। অতর্কিত মৃত্যুর মত
তারা। অথচ যে মুহূর্তে তাদের তুমি খুঁজে পাবে, পার হতে যাবে, মনে করবে নিরাপদ, সেই
মুহূর্তেই তারা রূপান্তরিত হবে আর একটা নতুন ফাঁদে। এটাই zone। খামখেয়ালি। অনিশ্চিত আর রহস্যময়।
যেন জীবনেরই আর এক রূপক বর্ণনা করছেন তারকোভস্কি এখানে।
প্রতীক নয়। রূপক। জীবনের সাথে যার আজন্ম লালিত গভীর নিগূঢ রক্তমাংসের সম্পর্ক।
স্টকার বলে, এই জোন এ যা কিছু ঘটে সেটার দায় এই স্থানের নয়। আমাদের প্রতিটি কাজ
দায়ী তার জন্যে। আমরাই দায়ী। আর সে জন্যেই সংযমী হতে হয় আমাদের। আর সব বিপন্নতাকে,
বেদনার সব যন্ত্রনা কে সহ্য করতে হবে আমাদেরই।
বিজ্ঞানী সংশয়ী। প্রশ্ন করে, তার মানে শধু যারা ভালোমানুষ
তারাই পারবে? খারাপ মানুষরা পারবে না এখানে আসতে? এই ঘরে প্রবেশ করতে?
এই সেই মুহূর্ত যখন মানুষ মুখোমুখি দাঁড়ায়, চোখে চোখ রাখে,
মানুষের সভ্যতার ধ্বংসকামী অভিমুখের দিকে। স্টকার বলে, ভালোও নয়, খারাপও নয়। যে
মানুষ সব হারিয়েছে, কোনও দিকে কোনও আশা নেই যার, শুধু সেই পারে এখানে পৌঁছতে।
তবু শেষ অবধি এই গন্তব্যে পৌঁছনো যাবে কি না সেই ভরসা কোথাও
থাকেনা। তারকোভস্কি প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে ধরেন আমাদের সামনে। এই জীবন, এই
পৃথিবী, এই অবিনাশী সময়কে ব্যাখ্যা করবার জন্য নয়। শুধু তার অন্তর্নিহিত সুরের
সাথে নিজের সুর কে মিলিয়ে দেখার জন্য।
সব হারিয়ে ফেলার এই রাস্তায় স্টকার’এর সঙ্গী হন তারকোভস্কি।
আর সেই সঙ্গমায়ার জাদুতে বিস্মিত আমার মত কেউ কেউ, তার সৃষ্টির সামনে চিরদিন
স্তব্ধবাক হয়ে বসে থাকে।
No comments:
Post a Comment