Saturday, May 5, 2018

বাংলার রাম ইতিহাসে নেই : প্রসূন মজুমদার






                       বাংলার রাম ইতিহাসে নেই
  
   
রামকে নিয়ে রাজনীতির জাগলিং, গো-বলয় পেরিয়ে ঝাড়খণ্ড বর্ডার দিয়ে এখন যে বাংলায় বেশ ভালোভাবে ঢুকে পড়েছে সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না।একদিকে ক্ষমতার গুড়ে ডুবে থাকা  অথর্ব সি,পি,এম- এর ক্ষমতা হারিয়ে দিশাহারা হয়ে যাওয়া আর অন্যদিকে তৃণমূল সুপ্রিমোর হিজাব- সংস্কৃতির ফাঁক গলে হনুবাজির কুৎসিত লম্ফঝম্প বাংলার সংস্কৃতিতে গ্রীষ্মের বিষফোঁড়ার মতো টনটন করছে।

     এই পরিস্থিতিতে রামকে ঐতিহাসিক চরিত্র প্রমাণ করার হুজুগ দেখে আমার চক্ষু মোটেই ছানাবড়া হয় নি,বরং বিরক্তির একশেষ হয়েছে। সোজাসুজি যে কথাটা বলে শুরু করতে চাই সেটা হলো,রাম যে ঐতিহাসিক চরিত্র নয়,সেটা একটু,মানে সামান্য বোধ থাকলেই বোঝা যায়। সুতরাং রামমন্দির ইস্যুতে যারা দাঙ্গা বাঁধায় তারা প্লেন ধান্দাবাজ। রামকে কেন এতো গুরুত্ব দেওয়া হলো সেকাল এবং একালে সেটা ভেবে দেখলেই ব্যাপারটা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যাবে।রামকে নিয়ে যে কাব্যটি বাল্মীকি মশাই লিখলেন তাকে নিয়ে নাচানাচি করা সেই সময়ের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত স্বাভাবিক।প্রথম কথা হলো, রামায়ণ কি ঐতিহাসিক উপন্যাস জাতীয় কিছু? যদি তাই হয় তাহলে রামায়ণে বা তৎকালীন অন্যান্য সাহিত্যে সেই দাবী করা হয় নি কেন? কেন রামায়ণ আলোচনার এতটা জায়গা পেয়েছিল? এই কাব্যটা যে ভাষায় রচিত, সেই ভাষাটির নাম দেবভাষা। অর্থাৎ কিনা দেবতাদের ভাষা।দেবতারা /হিন্দু দেবতারা কি তবে সবাই সংস্কৃতে কথা বলেন?যারা রামায়ণকে দৈবী কাব্যজ্ঞানে লাফাচ্ছে তারা একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে যে এই ভাষা দেবতাদের নয় সেই সময়ের আর্য জাতির মুখের ভাষা। এটা যে আর্যদের ভাষা সেই সম্বন্ধে সমস্তরকম ঐতিহাসিক তথ্য আমাদের ভাষাবিজ্ঞান দিয়েছে। সুতরাং একথা মানতেই হবে যে দেবতা বলতে সেই সময়ের আর্যদেরকেই এই কাব্যে বোঝানো হয়েছে।আর্যরা বৈদেশিক ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে ভারতবর্ষ-এর উত্তরাংশে আধিপত্য কায়েম করলেও দক্ষিণ ভাগে তেমন থাবা বসাতে পারে নি।দক্ষিণের দ্রাবিড়রা যারা আর্যদের বহুপূর্ব থেকেই এ-দেশের বাসিন্দা, তারা আর্যদের প্রতিরোধ করেছিল। এটাই ইতিহাস। ইতিহাস আরো বলে যে সিন্ধুতীরে বসবাস গড়ে তোলা আর্যরা সিন্ধুকে হিন্দু উচ্চারণ করতো আর এখান থেকেই হিন্দু ধর্মের কথা এসেছে।তাহলে যারা ইতিহাস-নিষ্ঠ হতে চায় তাদের ইতিহাসকে মানতে হলে এটা প্রথমেই মানতে হবে যে, আর্যজাতি বৈদেশিক শক্তি।উল্টোদিকে দ্রাবিড়রা, যাদের কুলতিলক ছিলেন রাবণ, সেই দ্রাবিড়রা দেশীয় শক্তির প্রতিভূ। এখন যে R.S.S আমাদের দেশপ্রেমের কথা বলে,রামকে দেশের শুভ শক্তির ধ্বজা বলে প্রচার করে, সেই ধর্মীয় দলটি ইতিহাসকে যদি মেনে নেয় তবে তাদের এটা প্রথমেই মেনে নিতে হবে যে আর্য রামের অরিজিন পারস্য,অর্থাৎ বিদেশ। তবে মুশকিল হলো এই যে এই স্বয়ং সেবকেরা আবার নিজের মতো ইতিহাস লিখতে শুরু করেছে।আর্যদের তারা এদেশীয় বলে দাবী করেছে।যদিও সেই দাবীকে সমর্থন করে যে কুযুক্তি তারা বুনেছে সেই যুক্তি কোনো লেখাপড়া জানা মানুষ মানতে পারে বলে মনে হয় না।
     এখন মূল কথায় ফেরা যাক, এদেশের আদি বাসিন্দা রাবণ। তাকে রাক্ষস বলে দেগে দিয়ে আর্যরা যে খেল দেখালো একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে যে সেই একই খেলা পরবর্তী কালে ইংরেজ দেখিয়েছে।তারা নিজেদের সরাসরি দেবতা বলতে একটু লজ্জা পেয়েছে বলে বলেছে যে সাদা চামড়ার মানুষ দেবতার বরপুত্র। আর কালোরা দেবতাদের অভিশাপ নিয়ে এসেছে।এই প্রচার করে তারা এশিয়া আর আফ্রিকার ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছে সেটা কিন্তু ঐতিহাসিক। এবার তাহলে দেখুন এই আর্যরা ইংরেজ,স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, পর্তুগিজ জলদস্যুদের থেকে মানে হার্মাদদের থেকেও নির্লজ্জ। এরা নিজেদের দেবতা বলেছে।নিজের ভাষাকে দেবভাষা বলে গর্বে বুক ফুলিয়েছে আর নিজেদের মহৎ প্রমাণ করতে দেবভাষায় রচিত কাব্যকে প্রচারের মাধ্যম করেছে।একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন যে সেই - সময়ে প্রচারমাধ্যম হিসেবে খবরের কাগজ /টি.ভি/ইন্টারনেট ছিল না।ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মাইকমুখে চ্যাঁচালেও ছিল না।তখন প্রচারের মাধ্যম ছিল কাব্যসাহিত্য।সুতরাং, সেখানে রামকে ভগবান বানানোর প্রয়োজন আর্য শাসকদের পক্ষে দরকারি ছিল।কিন্তু এদেশীয় মানুষদের রাক্ষস, বানর,ভল্লুক বলে দাগিয়ে দেওয়া মানবতার প্রতি ভয়ঙ্কর ক্ষতিকরই শুধু নয় অত্যন্ত নিম্নরুচির বলেই মনে হয়।এই সময়ে দাঁড়িয়ে বডি-শেমিং ব্যাপারটাকে আমরা যদি অসভ্যতা বলি, তবে রামায়ণে বর্ণনা করা কালো চামড়ার বা লোমশ মানুষদের রাক্ষস বা বানর বলাটা নিশ্চয় অসভ্যতার শামিল বলেই মনে করি আমি।

   শাসকের এভাবে নিজেকে দেবতা বলে প্রচার করার রাজনীতি রাবণকে ভিলেন বলে প্রচার শুরু করে। কিন্তু রামায়ণ নামক এই কাব্যের হিরো যদি রামকে ধরতেই হয় তাহলে বলতে হয় আমরা 'যো জিতা ও হি সিকান্দার'-এর তত্ত্বে বিশ্বাস করি।রামায়ণ ঐতিহাসিক  কাব্যও যদি ধরে নেওয়া যায় তাহলে রামায়ণে বর্ণিত কাহিনীগুলোকেও ঐতিহাসিক বলতে হয়।বলতে হয় যে ইন্দ্র আর অহল্যার গল্পও ঐতিহাসিক। বলতে হয় দেবরাজ ইন্দ্র ছিলেন কামান্ধ।কামান্ধ পুরুষকে দেবতাদের রাজা মেনে নিতে হিন্দুত্ববাদীদের গর্ব হয় কী করে! রামায়ণ যদি ঐতিহাসিক হয় তাহলে শুধু রাম নয়,রাবণও ঐতিহাসিক চরিত্র।তাহলে মধুসূদন যখন বলেন, 'Ravana was a grand fellow'  তখন আমাদের  R.S.S-এর হিন্দুরা কী বলবেন? সত্যিই কি মধুসূদনের দেখার চোখ কোথাও ভুল ছিল? আমি অন্তত মনে করি না।

   রাবণের একটা মহাপাপের কথা রামায়ণে বলা হয়েছে,তা হলো পরস্ত্রী - হরণের পাপ।বেশ।এবার দেখুন,রাবণ কি পরস্ত্রী - হরণ করে তার কামনা তৃপ্ত করেছেন?না। বরং সীতাকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত রেখে তিনি অশোকবনে তাকে বন্দী করেছেন। সীতার দেখভালের জন্যে রেখেছেন চেঁড়িদের।তাদের মধ্যে সীতার সর্বক্ষণের সেবার জন্য নিয়োগ করেছেন সরমাকে। তাঁর কাছে সীতা ছিলেন পণবন্দী।এবার কথা হলো তিনি বিনা প্ররোচনায় সীতাহরণ করেছেন? প্ররোচনা ছিল। সেটা কী? না রাবণের বোন শূর্পণখা রামের কাছ থেকে বিশ্রীভাবে অপমানিত হয়ে ফিরেছিলেন।তিনি কী দোষ করেছিলেন? না তিনি রামকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।এবার আসুন এই শূর্পণখার নাসিকা-কর্তন প্রসঙ্গে। একজন মহিলা যদি কোনো পুরুষকে প্রেম -প্রস্তাব দেয় তাহলে তা কি হিন্দু - শাস্ত্রমতে অসিদ্ধ?কখনও না।বরং হিন্দু-ধর্ম-শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, কোনো নারী যদি কোনো পুরুষকে প্রেম-প্রস্তাব দেয় তবে শাস্ত্রমতে পুরুষকে সেই প্রস্তাবে স্বীকৃত হতে হবে।এক্ষেত্রে মহিলাকে প্রত্যাখ্যান করাই অসিদ্ধ। আমার এই বক্তব্যের সমর্থন আপনারা পাবেন,মহাভারতে অর্জুনের উর্বশীকে প্রত্যাখানের আখ্যানে।তবে?শাস্ত্রমতে রাম প্রথম অপরাধটি করেছিলেন। অপেক্ষাকৃত দুর্বল নারীর ওপর অস্ত্রাঘাত এবং অঙ্গহানির সেই অপরাধের দায় 'ভগবান' শ্রী রামচন্দ্র এড়িয়ে যান কীকরে?

       এবারে প্রশ্ন হলো রাম,লক্ষ্মণ তো শূর্পণখার নাক কেটেছিল তাতে রাবণ সীতাহরণ করবেন কেন? রাবণের কী করা উচিত ছিল? বোনের মর্যাদা রক্ষা বা মর্যাদাহানির প্রতিশোধ নেওয়া তো ক্ষত্রিয় বীরের ধর্ম।সেই ধর্ম পালন না করাই তো অধর্ম। সুতরাং রাবণকে প্রত্যাঘাত করতেই হতো।কিন্তু ভেবে দেখুন রাবণ প্রত্যাঘাতের জন্যে পাঠালেন খর আর দূষণকে। তাদের রাম হত্যা করেন। এরপরে যেকোনো যোদ্ধারই উচিত সন্তর্পণে এগোনোর।রাবণ যখন দেখলেন রাম তার নিজস্ব ভূমিতে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই তিনি যুদ্ধ করতে রামকে নিজের পরিচিত অঞ্চলে টেনে আনবেন।রাবণ তাঁর যুদ্ধ - কৌশল হিসেবে সীতাকে পণবন্দী করেন। এই পর্যন্ত রাবণের দোষ বা পাপ তো আমি দেখিই না,বরং পুরো ঘটনা,রাবণের যুদ্ধ - কৌশলে বুদ্ধিমত্তারই পরিচয় দেয়। 

    এবার আসি 'হিন্দু ভগবান' রামের কৃতকর্মের দিকে।রাম যখন সীতাকে খুঁজতে বেরিয়ে সুগ্রীবের সুহৃদ হলেন তখন তাঁদের সৌহার্দ্য যতটা না আন্তরিক ছিল তার থেকে অনেক বেশি রাজনৈতিক ছিল। কারণ সেই বন্ধুত্বের বন্ধনে দেওয়া-নেওয়ার চুক্তি ছিল। সেই চুক্তি মাফিক রাম যে কাজটা করে ফেললেন তাতে তাঁকে ভর্ৎসনা ব্যতীত আর কীই বা করা যায়?  তিনি বালিবধ করলেন সম্পূর্ণ অন্যায্য পদ্ধতিতে। এভাবেই কখনও মায়া কখনও দৈবী শক্তি, কখনও দুর্নীতির সহায়তা নিয়ে রাম শত্রু নিধন করেছেন।ইন্দ্রজিৎ আর রাবণকে হত্যা করার সময়েও যুদ্ধনীতির পশাৎ-এ তিন লাথি মেরে অধর্মের তির বর্ষণ করে ধর্ম-প্রতিষ্ঠার ধুয়ো তুলেছেন।

       কী ধর্ম প্রতিষ্ঠা হলো? রাক্ষসেরা কি কষ্টে ছিল রাবণের রাজত্বে?  তারা তো স্বর্ণলঙ্কার অধিবাসী ছিল। তবে?রাম যদি ইতিহাস হন,তার লঙ্কা-বিজয় যদি ইতিহাস হয়, তবে ইতিহাস রাবণ পরবর্তী লঙ্কার পরিস্থিতি নিয়ে কী বলে? তারা এই যুদ্ধর পর হীণবল হয়ে যায় নি? রাক্ষসদের এই পরাজয় ঐতিহাসিক না? আসলে কাব্য রচনা করে রামের বিজয়গাথা প্রচার করে সুকৌশলে আর্যরা নিজেদের মহৎ আর তদানীন্তন ভারতবাসীকে হীণ বলে দেগে দিল।

     এইবার প্রশ্ন হলো যে রাম কাদের ভগবান? এতক্ষণে আমি নিশ্চয় বোঝাতে পেরেছি যে রাম ঐতিহাসিক চরিত্র বলে দাবী করলে রামভক্তদের অসংখ্য প্রতিকূল প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে।আর ভগবানের দেবত্ব রাক্ষসত্বের চেয়েও যে বেশি সাংঘাতিক তার বেড়াল ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়বে।এইবারে আসা যাক এই প্রসঙ্গতে যে বাংলার ইতিহাসে রামের দেবত্ব কবে গৃহীত হলো।বাংলার যে বাঙালি জাতিসত্তা সেটা নির্ণীত হয় কিভাব? এই বিষয়ে একটা সাধারণ ভ্রান্ত ধারণাকে আগে ঝেড়ে ফেলা দরকার। কোনো জাতির জাতীয় সত্তা স্থানিক হতে পারে না।অর্থাৎ বাঙলায় যারা থাকে তারাই বাঙালি এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।তেমন যদি হতো তবে ভুতুরিয়া,কানোরিয়াদেরও বাঙালি বলতে হতো।আসলে,যেকোনো জাতির সত্তা নির্ণীত হয় ভাষা দিয়ে। কারণ জাতির সংস্কৃতি প্রকাশ পায় ভাষার সিগনিফায়ারগুলো দিয়ে। তাই ভাষা আর সাহিত্যের ইতিহাসটা ঘাঁটলেই রামের বঙ্গজ ঐতিহাসিক অস্তিত্বটা প্রকট হবে।বাঙলা- সাহিত্যের ইতিহাসে একটু চোখ বোলালেই দেখবেন যে বাংলা ভাষায় চর্যা এসেছে, আর চর্যার হাত ধরে হিন্দুধর্মের নবম অবতার বুদ্ধ এসে ঢুকেছেন খ্রিষ্টীয় দশম/মতান্তরে অষ্টম শতকে।অষ্টম অবতার কৃষ্ণ ঢুকে পড়ছেন চতুর্দশ শতকে।শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভিতর দিয়ে। অবশ্য সেই কৃষ্ণের দেবত্ব ভাবের চেয়ে মানবতা ভাব বেশি।রাম, সপ্তম অবতার আসছেন আরো কিছুটা পরে কৃত্তিবাসের পাঁচালিতে। এর মধ্যে বঙ্গদেশ হনুমান সংস্কৃতিকে পায় নি। যুদ্ধের মাধ্যমে শান্তি এই ফিলোসফিটা বাংলার সংস্কৃতি মানতো না বলেই সে শান্তির এবং আত্মিক উন্নতির মানব-অবতার বুদ্ধকে আগে গ্রহণ করেছিলো।১২০১ থেকে মুসলমান শাসকের ঠেলায় পড়েও তাকে যুদ্ধর দিকে ঢলে পড়তে হয় নি।তাই বাংলা সাহিত্যের কৃষ্ণ যুদ্ধবাজ না। প্রেমিক কৃষ্ণ। প্রেম আর আত্মগত সাধনাকেই বাংলা তার সংস্কৃতিতে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এর কারণটা একটু ভাবলেই বোঝা যাবে। আসলে সুজলা- সুফলা বাংলাদেশে অন্নের অভাব রুক্ষ প্রকৃতির দেশের থেকে অনেক কম।তাই ছিনিয়ে খাবার মানসিকতাও তার চরিত্রে কম। এইরকম একটা পরিমণ্ডলে বাংলায় যখন কৃত্তিবাসের কলম বেয়ে রাম ঢুকছেন তখনও সেই রাম বাল্মীকির বীররসে প্লাবিত হয়ে ঢুকছেন না।বরং সফট ভক্তিরসে ভিজে মিনমিনে হয়ে ঢুকছেন। তাই বাংলার রামপুজোয় আগে কেউ কখনো অস্ত্র নিয়ে লাফায় নি। রামপুজো কি বাংলায় তবে অপ্রচলিত ছিল?মোটেই না।বাংলার কৃষকদের ঘরে আজও রামায়ণ পাঠ হয়।কৃত্তিবাসী রামায়ণকে পুজো করা হয়। তরোয়াল নিয়ে লম্ফঝম্ফ করার প্রথা সেই পুজোয় নেই। রামকে বীরত্বের প্রতীক বলে পুজো করে গোবলয়ের লোকেরা,জাঠরা।এরা মারকুটে ধরণের গায়ে-গতরে উশুল করার সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে।কিন্তু বাংলা শারীরিক বলের থেকে বোদ্ধিক ক্ষমতার উপরেই বেশি বিশ্বাস রাখতো।দেশ স্বাধীন হবার পর হিন্দি যখন কাজের ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হলো,আর বাংলার লোকেদের মধ্যে প্রচার করা হতে থাকলো হিন্দি, ইংরেজি না পড়লে সুখ পাবে না,তখন থেকেই বাঙালি তার জাতিসত্তাকে হারাতে শুরু করলো।কারণ ওই ভাষা।ভাষাই আসলে নির্ধারণ করে জাতীয় সত্তা। এরপরেও বাঙালি কিছুটা টাল সামলে নিয়েছিল কারণ সে একটা বাম-আন্দোলন আর অতি-বাম আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল।সেই আন্দোলন দুটো আদর্শ - নিষ্ঠা আর ইন্টেলেক্টকে দৈহিক পার্থিব সুখের উপরে স্থান দিয়েছিল।মুক্ত-বাজার অর্থনীতি, বামেদের নৈতিক বিপর্যয় দেখতে দেখতে বাংলা এখন আর ছাড়তে রাজি নয়,কাড়তে তৈরি। এই অবস্থায় তাকে যতই বোঝাও সে বাংলা শিখবে না।ইংরেজি আর হিন্দি শিখবে।তাই তার রাম আর রামরাজত্ব চাইবে না। সে মায়াসীতার মতো মায়া-মুসলমান-ক্রাইসিস মেলে ধরে গোবলয়ের মতো গোল পাকাবে, এতে আর অবাক হবার কী আছে! যে জাতি আত্মবিস্মৃত তাকে বাঁচানো মুশকিল। রাম ঐতিহাসিক চরিত্র এমনটা যদি হয়েও থাকতো,সে রাম নিশ্চয়ই বাল্মীকির রাম।বাংলার রাম কৃত্তিবাস নিজে হাতে গড়েছেন।সে রাম, রাবণ, সীতা সকলেই বাঙালির ঘরের লোক।সেখানে রাবণ তো রাক্ষস নয়,বরং সে বাংলার চরিত্রহীন জমিদার।সীতা বাংলার গৃহবধু।আর রাম?  সে নেহাৎই ভ্যাদভেদে স্বামী যে সীতা-বিনা মণিহারা ফণী।
         সুতরাং বাংলার আর বাঙালির কোনো অর্থ নেই রামকে নিয়ে মেতে ওঠার কিম্বা রামনবমীতে হনুমানের মতো লাফানোর।বাংলায় রাম স্পষ্টত এক কাব্যের চরিত্র।সে কাব্যের নাম রামায়ণ নয়।সে কাব্যের নাম ' শ্রীরাম পাঁচালি'।

  অতঃপর যে বাঙালি তার সংস্কৃতি ভুলে R.S.S-এর কথায় লাফাচ্ছে আর অস্ত্রমিছিল করে মায়া-সংকটের দোহাই দিয়ে হুজুগে মেতেছে তাদের বলি যে বঙ্গ ভাজপা কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার খড়কেকাঠি।গ্রামে গ্রামে খড়কেকাঠিরা যেভাবে মেয়ে ফুসলে নিয়ে গিয়ে বেচে দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করে, ঠিক সেইভাবে এই R.S.S কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্যে বাংলার সংস্কৃতিকে হিন্দি বলয়ে বেচে দিচ্ছে। এই কঠিন সময়ে যদি আর একটু চিন্তা করে এগোনো যায় তাহলে আমি নিশ্চিত এই গো-বলয়ের কূট - যুদ্ধবাজ রামের হাত থেকে আমাদের বাংলার সংস্কৃতির এখনও পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।



No comments:

Post a Comment

দেবমাল্য চক্রবর্তী

মা নিষাদ   ‘শয়তান, তুই নরকে যাবি পাপ-পুণ্যের জ্ঞান নেই তোর, শয়তান, তুই নির্ঘাৎ নরকে যাবি অভিশাপ দিচ্ছি তোকে, তুই নরকে যাবি’ দস্য...

ক্লিক করুন। পড়ান।