Friday, May 4, 2018

নাটক দেখা : স্নেহা দত্ত








                                         স্মৃতির সত্তায়,গোধূলির গানে
             




গত ২রা থেকে ৪ ঠা ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সহযোগিতায় "ঐহিক " নাট্যদলের উদ্যোগে এক নাট্যোৎসব অনুষ্ঠিত হয় মুক্তাঙ্গন রঙ্গালয়ে।"বাংলার নট নটী" শীর্ষক এই উৎসবে তিন দিনে মোট বারোটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের নাটক মঞ্চস্থ হয়,যেখানে "ঐহিকে"-এর নিজস্ব প্রযোজনা ছাড়াও কলকাতার "বালিগঞ্জ ব্রাত্যজন"এর মতো নামী দলের পাশাপাশি "দুর্গাচক কোরক" কিংবা "জলপাইগুড়ি উজান"এর মতো জেলার দলগুলিও পরিবেশিত করে তাদের নাট্য প্রযোজনা।তবে,শেষ দিনের চারটি নাটকের মধ্যে দ্বিতীয় নিবেদন  " বিদ্যাসাগর কলেজ ড্রামা ক্লাব" এর "গোধূলি গগনে মেঘে" নাটকটি এক ভিন্ন সুরের অণুরণন তুলেছিল দর্শকদের মনে।তিনটি চরিত্রের জীবন,যাপন,স্বপ্ন আর স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে এই নাটকটি যেন কোথাও প্রায় আমাদের সকলেরই চেনা, বলা এবং বলতে না পারা কথাকেই চিত্রিত করেছে  প্রসেনিয়ামের তিন দেওয়ালের ভেতরে।



এই নাটক শুরু হয় সুতপার মনোলোগ দিয়ে।দামি ফ্ল্যাটের সুসজ্জিত ড্রইংরুমে সে ব্যস্ত থাকে ল্যাপটপের কাজে।বিজ্ঞাপন সংস্থায় কর্মরতা সুতপা অফিসের পরও ডুবে থাকে বকেয়া কপি লেখার ভেতরে।একটার পর একটা কাজের ফোন ধরতে ধরতে ব্যস্ত চরিত্রটি ক্রমশ ডুবে যায় অভ্যস্ত যান্ত্রিকতার ভেতর।সামান্য রিলাক্সেশনের উপায় হিসেবে সে বেছে নেয় সিগারেট আর গুনগুন করে গেয়ে ওঠা পুরোনো গানের সুরকে।তারপরই প্রবেশ ঘটে অমিতের।অমিত,পেশায় ইঞ্জিনিয়ার।এক সময়ে সুতপার এই প্রেমিক বর্তমানে তার স্বামী।সাইট ভিজিট আর অফিসিয়াল ট্যুরে ডুবে থাকে সে।এখন দুজনের পারস্পরিক কথায় কেবল উঠে আসে টাকার প্রসঙ্গ,লিভিং স্টাইলকে আরও বেটার করার পরিকল্পনা।ছকে ফেলা জীবনের আয়-ব্যয়ের হিসেব করতে করতে দুজনেই যেন হারিয়ে ফেলেছে দুজনকে।তাই,অমিতের হঠাৎ গুনগুন করে গেয়ে ওঠা গানের সূত্র যেন আচমকাই উস্কে দেয় সুতপার ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিকে।তার মনে পড়ে পুরোনো অমিতকে,ফেলে আসা সোনালি দিনের কথা।তারপরই বদলে যায় নাটকের মোড়।দর্শকের সামনে চকিতে হাজির হয় পাঞ্জাবি পরা, কবিতা-গানে ডুবে থাকা অমিত,সুতপার স্মৃতির রেশ ধরে।আর সেই অমিতকে ঘিরেই সুতপা স্বপ্নের ঘোরে বুনে চলে আরেকটা স্বপ্ন।অর্থ-কীর্তি-স্বচ্ছলতার বাইরে গিয়ে সে বিভোর থাকে সুরের মূর্ছনায়,কবিতার ছন্দে,বাস্তবের না মেলা আকাঙ্ক্ষার অতলে।এরই মধ্যে মিলিয়ে যায় স্বপ্নের অমিত,আর বাস্তবের অমিতের ডাকে ঘোর কাটে সুতপার।জানা যায়,পুরোনো বন্ধু তন্ময়ের সঙ্গে দেখা হওয়ায় অমিত তাকে রাতে বাড়ি আসার নিমন্ত্রণ জানিয়েছে।আর তখনই যেন নাটকের কাহিনি আছড়ে পড়ে কঠিন বাস্তবের মাটিতে।তন্ময়ের এ হেন আসার প্রবণতা ভাবিয়ে তোলে সুতপাকে।সে ব্যস্ত হয় অগোছালো ঘর সাজানোয়,অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাকে আরও বেশি বিজ্ঞাপিত করার প্রবণতায়।বন্ধুকে আচমকা নিমন্ত্রণের জন্য অমিতকে ভর্ৎসনা করতেও দ্বিধা হয় না তার।আর এক সময়ে দুজনের জীবনে গভীর ভাবে জড়িয়ে থাকা বন্ধুর জন্য স্ত্রীর এ জাতীয় ফর্ম্যাল আচরণ ভাবিয়ে তোলে অমিতকে।আবারও বদলে যায় নাটকের ঘটনা।বৈবাহিক জীবনে একটু একটু করে রোজ  পালটে যাওয়া মানুষটাকে অচেনা লাগে অমিতের।আর অচেনা সুতপার ভেতর সে হন্যে হয়ে খুঁজতে চায় এক সময়ের প্রেমিকা সুতপাকে।বর্তমান সময় আবার বদলে যায় ফ্ল্যাশব্যাকে।হারিয়ে যাওয়া,দুদিকে বিনুনি বাঁধা, গানের ক্লাসে যাওয়া সুতপা হাজির হয় এবার অমিতের সামনে,ফেলে আসা সময়ের দাবি নিয়ে।কিন্তু বাস্তবের নায়ক চাইলেও সাড়া দিতে পারে না ফেলে আসা সময়ের ডাকে।তাই স্বপ্ন বাস্তবের আলো আঁধারি রেশ নিয়ে মিলিয়ে যায় সুতপা,আর সেখান থেকেই প্রবেশ করে তন্ময়।যে কিনা একই সঙ্গে জুড়ে দেয় বাস্তব আর ফেলে আসা টুকরো ছবির মায়াকে।অমিতের মনের মধ্যে জমতে থাকা অভিমানের প্রশ্নগুলোকে,ভালো থাকার মিথ্যে মোহকে,অর্থের পিছনে ছুটতে ছুটতে ক্রমশ অর্থহীন হয়ে পড়া জীবনের দিকে আঙুল তোলে সে।আর এই তিনটি চরিত্রের অবস্থানেই ঘনীভূত হয় নাটকের দ্বন্দ্ব। বাকিটুকু অপেক্ষার গল্প।গোধূলির মেঘে ঢেকে থাকা সন্ধ্যাতারা আগামিকাল ভোরে শুকতারা হবে কিনা....এ প্রশ্ন ছড়িয়ে যায় দর্শকের মনে।আসলে বেঁচে থাকা আর আপাত সুখের মধ্যে টিকে থাকার তফাৎ কতখানি, এই নাটক আমাদের চেতনায় কড়া নেড়ে বলে দেয় তা।



এবার আসা যাক মঞ্চসজ্জার কথায়।বেতের সোফা সেট,দামি বইয়ের র‍্যাক,সাজানো শো পিস আসলে হ্যাপি কাপলের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছল্যের জৌলুসটিকে আমাদের সামনে এনে দেয় শুরু থেকেই।আর তাকে আরও বেশি ব্যঞ্জনায় মুড়ে দেয় বাবলু সরকারের আলোক ভাবনা।বিশেষত ফ্ল্যাশব্যাকের দৃশ্যগুলোয় নীল আলোর ব্যবহার যে মায়াবী পরিবেশ গড়ে তোলে,তা এক কথায় অপূর্ব।তবে এ নাটকের দৃশ্য পরিকল্পনা এবং সংলাপ যেন আরও বেশি প্রাণবন্ত করে তুলেছে নাট্যমুহূর্তকে।এইই নাটকের সংলাপে এক অদ্ভুত হৃদস্পন্দন আছে,যা কানে আর মনে দীর্ঘস্থায়ী অনুরণন তোলে।সেই সঙ্গে বাস্তবের ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাকে বদলে যাওয়া আর ফ্ল্যাশব্যাকের রেশ ধরে চকিতে বাস্তবের রূপ নেওয়ার দৃশ্যায়ন প্রক্রিয়াটি এত চমৎকার ভাবে নির্মিত হয়েছে,যা দর্শককে যাদুমন্ত্রের মতো মোহিত করতে সক্ষম হয় চূড়ান্তভাবে।নাটককার ও নির্দেশক পিয়াল ভট্টাচার্যের মুন্সিয়ানার চরম প্রকাশ ঘটেছে এখানেই।স্বপ্ন আর বাস্তবের টানাপোড়েনের কাহিনিকে পিয়াল শুরু থেকে যেমন টানটান বুনেছেন,তেমনই "এখন" আর "তখন" এর সেতুটি তন্ময় চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতায়।

অভিনয় এ নাটকের আরেকটি সম্পদ। সুতপার ভূমিকায় শ্রীজাতা সেনগুপ্তের অভিনয় দর্শককে মোহিত করে রাখে।অমিতের ভূমিকায় সৌরভ সাহা ও তন্ময়ের ভূমিকায় অভীক বাগচীর অভিনয় কেবল প্রশংসনীয়ইই নয়,মর্মস্পর্শীও বটে।তবে,গান গাওয়ার সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে শ্রীজাতা এত বেশি সচেতন হয়ে পড়ছিলেন সুর নিয়ে,অভিনয়ের মধ্যেও যেন সেই সচেতনতা ধরা পড়ছিল।আর ফ্ল্যাশব্যাকের একটি দৃশ্যে সৌরভ সম্পূর্ণভাবে না নেভানোয় অ্যাশট্রেতে চাপা পড়া সিগারেট থেকে বার হওয়া ধোঁয়ার কুণ্ডলী ভেসে আসছিল পরবর্তী বাস্তব ঘটনার দৃশ্যে।আগামি অভিনয় গুলোতে এই সামান্য ত্রুটিটুকু না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।



গান এই নাটকের আলাদা অলংকার।"গোধূলি গগনে মেঘে"র মতো পরিচিত রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি নাটকের প্রয়োজনে কখনো উঠে এসেছে সত্য চৌধুরীর " পৃথিবী আমারে চায়",আবার কখনো জীবনের গল্প বেঁকে গেছে " এক প্যায়ার কা নগমা হ্যায়" এর ভেতরে।তবে,শেষ মুহূর্তে নাটকের স্বপ্ন বেঁধে দেয়  মুকেশের আর একটি গান " উয়ো সুবহ কভি তো আয়েগি"।আসলে,আমাদের জীবনে রূঢ় বাস্তবের চাপে গোধূলির মেঘে ঢেকে যাওয়া স্বপ্নের তারাটি ভোরের শুকতারায় বদলাবে কিনা জানা না থাকলেও শেষ দৃশ্যে ব্যবহৃত গানের সুরে সেই অনাগত, সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন যে সেদিনের অধিকাংশ দর্শক নতুন করে বুনেছিলেন এ কথা নি:সন্দেহে বলা যায়।অমিতের মতো সব কিছুকে বদলে ফেলে নতুন সূচনার স্বপ্নে যে সবাই কম বেশি উতলা,এই নাটক সেই মায়াবী রূপকথাকেই বলে চলে প্রচ্ছন্ন লিরিক্যাল মেজাজে।



* নাটক: গোধূলি গগনে মেঘে
* প্রযোজনা : বিদ্যাসাগর  কলেজ ড্রামা ক্লাব
* নাটক ও নির্দেশনা : পিয়াল ভট্টাচার্য

No comments:

Post a Comment

দেবমাল্য চক্রবর্তী

মা নিষাদ   ‘শয়তান, তুই নরকে যাবি পাপ-পুণ্যের জ্ঞান নেই তোর, শয়তান, তুই নির্ঘাৎ নরকে যাবি অভিশাপ দিচ্ছি তোকে, তুই নরকে যাবি’ দস্য...

ক্লিক করুন। পড়ান।