মায়া
১।
ওগুলু তিতো গাছের ডালে কাল রাতে রান্নার
শেষে পড়ে থাকা ছাই মাখিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে ঘরের বাইরে এসে
থমকে দাঁড়ালো। এখনো ভোর ফোটেনি ভালো করে। আধা
অন্ধকারে দূরের মাঠে যা দেখা যাচ্ছে তা অন্তত খান বিশেক তাঁবু। আভিবা রাজ্যের শুরুর প্রান্তে এই মাঠ। এরপর আছে পরিখা, উঁচু
পাথরের উঠে যাওয়া দেওয়াল। যা স্তরে স্তরে উঠে যাওয়া। বাইরে থেকে ত্রিভুজের মতো তার
আকার। দেওয়ালের ওপাশে রাজা মিটিংগার রাজত্ব, বাজার, স্নানাগার, হরেক পশরা দোকানের
রঙ-বেরঙ , আর আছে সুন্দরী রাতাইয়ার ঘর। রাতাইয়ার কথা মনে হলেই ওগুলুর মনটা কেমন
ছটফট করে ওঠে। এখন রাতাইয়া উদ্ভিন্নযৌবনা। চাঁদনীর মতো সারা শরীরের আলো ছড়াতে
ছড়াতে আভিবাকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। কিন্তু রাতাইয়া সাধারণ মানুষ নয়, বরং কোন মানুষ
তার সংস্পর্শে এলে মারা পড়বে। রাতাইয়া এই মায়া সভ্যতার বিষকন্যা।
ঘড়ঘড়
আওয়াজে সম্বিত ফিরলো ওগুলুর। রাতাইয়ার কথা ভাবতে ভাবতে সে সামনের মাঠের রহস্যজনক
তাঁবুগুলোর কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো। আবছা অন্ধকারমাখা সরকাটা আলোতে ও দেখতে
পেলো গুলতি ছোঁড়ার বিশাল বিশাল যন্ত্র বেরিয়ে আসছে তাঁবু থেকে। যন্ত্রগুলোর নিচে
কাঠের পাটাতনে কাঠের চাকা লাগানো থাকায় ঘড়ঘড় শব্দ উঠছে। এত গুলতি যন্ত্র এখানে কেন
এখানে! শিবিরেই বা কারা আছে। তবে কী যুদ্ধ লাগবে!
২।
সূর্যদেব
কিনিচ আহাউ এর পুজো শেষ করে সবে সমৃদ্ধির দেবতা কুলুলকানকে যবের অগ্রভাগ অংশটি দান
করছিলেন মিটিংগা, সেই মুহূর্তে দূত এসে খবর দিলো ঔকারি রাজার সৈন্যরা তাঁবু গেঁড়েছে
আভিবা রাজ্যের বাইরের মাঠে। উদ্দেশ্য যুদ্ধ। প্রথমে থতমত খেয়ে গেলেও পরমুহূর্তে
মিটিংগা চেঁচিয়ে উঠে নিজের বুক চাপড়ালেন। তিনি মনে করেন এতে তার শক্তি হঠাৎ বেড়ে
ওঠে। এই পিরামিডের মতো ত্রিভুজ আকৃতির মায়া সভ্যতায় তার শক্তির পরিচয় সকলের জানা।
রেগে গেলে এক দুর্দান্ত দানব ভর করে মিটিংগার ওপর। এমনিতেই এই সভ্যতা অনেক উন্নত
সমসাময়িক সভ্যতাগুলোর থেকে। আর তাছাড়া, মায়া সভ্যতার মূল ভিত্তি তাদের
জ্যোতিষবিদ্যার প্রসার। আকাশের নক্ষত্র কথা বলে ওদের সাথে। ওদের তৈরি মাসসূচিক
সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে। সেই ওদের সাথে লড়াইয়ের বাসনা হলো ঔকারিকদের! মিটিংগার
রাজসভায় সৈনিকেরথেকে জ্যোতিষীদের আদর বেশি। কমপক্ষে সত্তরজন জ্যোতিষীর মতামতের ওপর
নির্ভর করে রাজার সিদ্ধান্ত। মিটিংগা হুকুম করলেন ডাকো জ্যোতিষীদের। তারপর
বিরামকক্ষের জানলায় এসে দাঁড়ালেন। তাঁবুগুলো অস্পষ্ট নজরে আসছে বটে। মাথায় লালচে
পতাকা। রাজ্যের বাইরের মাঠগুলোতে খাদ্যশস্য চাষ হয়। সেসব নজরদারি করার জন্যে খেতের
মাঝে মাঝে চাষিদের ঘর তুলে দেওয়া হয়। তেমনই এক চাষি ওগুলু নাকি তাঁবু দেখতে পেয়ে
প্রথম খবর পাঠিয়েছে। ‘রাজা’--- হাত-পা প্রক্ষালন করাবার জন্যে মিতিলি এসে মৃদু
ডাকলো। মিটিংগা চমকে উঠে পিছন ফিরে হুংকার দিলেন ‘আগে জ্যোতিষী আসুক’। মুঠোর চাপে
তার গলা থেকে স্বাতী নক্ষত্র খোদাই করা সোনার হারটি খসে পড়লো।
৩।
আজ একটা
বটিকা নেওয়ার পরেও শরীর আনচান করতে লাগলো। আর একটা নিলে ভালো হয়। কিন্তু একটার
বেশি বটিকা খেতে বৈদ্য শিলিকা বারণ করেছে। রাতাইয়া আনচান শরীর নিয়ে পাত্রভরা স্থির
জলের কাছে দাঁড়ালো। প্রতিবিম্বের নারীটি আলোরছররা ছোটাচ্ছে। এতো রূপ তার! নিজেরই
বিশ্বাস হয়না। তবে পুরুষের চোখ দেখে ও বোঝে তার প্রতিবিম্ব মিথ্যে বলেনা। আর
পুরুষ... ওই চোখেই যা লুকোনো থাকে। কেউ কাছে আসতে সাহস পায়না। রাতায়া বিষকন্যা।
রাজ্যের জন্য উৎসর্গীকৃত। ওর বাবা মাও ওর কাছে থাকে না বিষ নিঃশ্বাসের ভয়ে। এ কেমন
জীবন ওর! জন্মানোর পরেই রাজা মিটিংগা ওকে দত্তক নিয়েছিলেন। সেদিন সভায় জ্যোতিষীরা
ওকে সর্বসুলক্ষণা ঘোষণা করে রাজ্যের জন্যে উৎসর্গ করে। সেদিন থেকে রাজবৈদ্য
শিলিকার ভার পড়ে ওকে একটু একটু করে বিষ বটিকা খাওয়ানোর। পরিমিত এক বিন্দু বটিকা।
শিলিকা গভীর বন থেকে নিজে হাতে নিয়ে আসে বিষ লতাপাতা আর সেসব বেটে তৈরি করে এই
বটিকা। এখন রাতাইয়ার বয়স ১৬, তাই বটিকার আকার বেড়েছে। তবে ওই একটা। বেশি খেলে
বটিকাই নাকি ওকে খেয়ে ফেলবে এমন বলে হাহা করে অট্টহাসে শিলিকা।
রাতাইয়ার
খুব মনখারাপ হয়। মাঝেমাঝে রাতে ঘুম ভেঙে খুব কান্না পায়। এ কেমন জীবন! সবাই ওকে ভয়
পায়, সবাই দূরে থাকে! বিষের প্রভাবে ওর চোখের রঙ নীলচে। পুরুষরা মুগ্ধ হয়ে তাকাবার
পরেই সম্বিত ফিরে পায় আর প্রায় ছুটে পালায়। ওর কী স্বাভাবিক জীবন থাকবে না আর
কোনদিন? কোন ভালোবাসা, কোন পালক স্পর্শে কোনদিন কেঁপে উঠবে না কোন রাত! ছোটবেলার
খেলার সাথী ওগুলু মাঝেসাঝে নগরে এলে ওর দরজায় এসে দাঁড়ায়। ওগুলুই একমাত্র যে
রাতাইয়াকে ভয় পায়না। তবু ও দূর থেকে কথা বলে । দুঃখের কথা। ওগুলুর প্রতি মন নরম
হয়ে গেছে কবে তা ও নিজেকে প্রশ্ন করেও জানতে পারেনি। কিন্তু এটা জানে যে এর পর আর
কিছু নেই। ওই কথাগুলোকে সম্বল করে বাঁচতে হবে তাকে। মনের দরজা দিয়ে বেরোলে কোন
চৌদোলায় চড়ে ওগুলুর ঘরে যেতে পারবে না। বরং এই বেঁচে থাকা ওকে গিলে খাবে জীবনভর।
৪।
জ্যোতিষ
আবাপ্পা এ রাজ্যের প্রাচীন পুরোহিত। তাঁর জ্ঞান অপরিমিত। মিটিংগা অবধি আবাপ্পার
পাদোদক পান করে রোজ রাজসভায় আসেন। সেই আবাপ্পা যখন অনেক গুনে, ছকের কাঠি মেপে
জানালেন শত্রুপক্ষকে বর্শা, পাথুরে গুলতি আর ফুঁ-পাইপে আটকানো যাবে না তখন
মিটিংগার রক্ত ঝিমিয়ে পড়লো। “কী করে তাহলে এ রাজ্যও, এ সভ্যতার কাঠামো আমার
প্রজাদের রক্ষা করবো বলে দিন গুরুদেব। কিছু ত উপায় আছে...।“
“আছে এক উপায়।“
মন্ত্রণাসভার
স্বর চিড়ে ধ্বনিত হলো “ কী উপায়? কী উপায়?”
‘বিষকন্যা
রাতাইয়া’
‘রাতাইয়া!’
‘হ্যাঁ ও
পারবে। আজ সূর্যদেব কিনিচ আহাউ অস্ত যাওয়ার পরে রাতাইয়াকে গড়ের বাইরের মাঠে যেতে
হবে। তারপর শত্রপক্ষের তাঁবুতে ঢোকার জন্যে ছলাকলার আশ্রয় নিতে হবে। বাকিটুকু আমি
না বলে দিলেও তোমরা বুঝেছও নিশ্চয়।“
উল্লাস
বয়ে গেলো সভা জুড়ে।
৫।
সন্ধে
ঘনিয়ে এলো প্রায়। রাতাইয়া, রাজ্যের একমাত্র বিষকন্যা, রাজ্যের জন্যে যে ছোট থেকে
উৎসর্গীকৃত আজ তার পুজো করছে রাজ্যের মানুষ। ঘরের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ফুল ছুঁড়ে
দিয়েছে। বড় বড় লাল ফুল। রাজার নির্দেশে আজ ওর ঘরে এসেছে রাজকীয় খাবার, বস্ত্রাদি।
রাতাইয়া আজ গায়ে কুর্চীফুলের তেল মেখেছে। তাই তার ফর্সা রঙের চকচকানিতে মসছি পিছলে
যাওয়াআভা। স্নানের আগেই অঙ্গরাগ মেখেছিল। মুখখানি প্রদীপের মতো স্নিগ্ধ জ্বলছে। আজ
ওর ষোলো বছরের জীবনের প্রথম উৎসব। অনেক বাছাইয়ের পরে নীলের ওপর কমলার সরু পাড়ের
শাড়িটাই পছন্দ হলো। চোখের রঙের সাথে মিলবে বেশ। কাজলের রেখা একটু বেঁকিয়ে দিলো আর
ঠোঁটে রঞ্জা ফলের রস। ফনা তোলা সাপিনীর মতো একটু একটু দুলতে ইচ্ছে করছে। আজ আর
শিলিকা বৈদ্যর কথা মানবে না ও। একটা নয় দু’টো বটিকা একসাথে খাবে। ঘন সবুজ বটিকা
দু’টো মুখে ফেলে দ্রুত পায়ে গড়ের মূল দরজার দিকে এগিয়ে গেলো রাতাইয়া।
No comments:
Post a Comment