হা-"রাম" বাই বনাম অ্যালিবাই
রাষ্ট্রের সংকট খুব বেশি মানুষকে সরাসরি স্পর্শ করে না, বরং তাকে
পারিবারিক মূল্যবোধের সংঘাতের সম্মুখীন হতে হয় প্রতিনিয়তই। এই মূল্যবোধগুলি
রামায়ণের নানা ঘটনাচক্রের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে, কাজেই রামায়ণে সাধারণ
মানুষ তার সমস্যার চিত্রণ ও সমাধান খুঁজে পেয়েছে; তাই রামায়ণকে ভারতীয় সমাজ সহজে
গ্রহণ করেছে আপন স্বল্প পরিসর সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে চিত্তলোকের পথপ্রদর্শন
হিসেবে।
তাই রামায়ণের পরম্পরায় রামকাহিনির শত ধারা বহুচর্চিত। উনিশ শতকীয়
রামায়ণ চর্চা নানা ধারার অন্বেষণের উত্তরাধিকারী। রামকাহিনির সূচনাকথা— ঋগ্বেদ,
বৌদ্ধ জাতক, জৈন কাব্যের সূত্রে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এমনকী মহাভারতের কোনও কোনও
পর্বেও রামকথা উল্লিখিত; আছে পুরাণকথাতেও। মধ্যযুগে বাংলা রামায়ণের রচয়িতাদের যে
ধারা তাতে মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর রামায়ণও স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে।
উনিশ শতকে শতাধিক রামায়ণ ও রামায়ণকেন্দ্রিক সাহিত্যসম্ভার মুদ্রিত
হয়, যা বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল সংযোজন। প্রথমার্ধের যে রচনা তাতে মূলত
কৃত্তিবাসেরই প্রভাব। একই সঙ্গে পুথির গায়ক ও কথকদের নিজ নিজ মৌলিকত্বের বিষয়ও প্রাধান্য
পেয়েছে। এরই সূত্র ধরে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাম চর্চার গতিপ্রকৃতি ও নিরীক্ষা
বিস্তৃততর হয়। তখন জনচিত্তজয়ী কৃত্তিবাসী রামায়ণ ছাড়াও সংস্কৃত বাল্মীকি রামায়ণের
ঐশ্বর্য উদ্ঘাটনে নানা রচনা অনূদিত ও মুদ্রিত হয়েছে। কিন্তু উনিশ শতকের প্রথম
পর্বে রামায়ণের অনুবাদে যে স্বকীয় ভাবপ্রসারী প্রবণতা লক্ষ করা যায় তা দ্বিতীয়
ভাগে এসে বহুলাংশে যথাযথ মূলানুসারী। এই শতকে নবচেতনার উন্মেষের মতো
রামায়ণকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার ধারা দেখা যায়। বৈশিষ্টপূর্ণ এই প্রচেষ্টায় কাব্য,
নাটক ও প্রবন্ধের নানা বিস্তার লক্ষ করা যায়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের রামায়ণাশ্রিত
মেঘনাদবধ কাব্য, হরিশচন্দ্র মিত্রের জানকী নাটক ছাড়া বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যেও
রামায়ণের নানা ব্যবহার ও প্রভাব রয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর
ত্রিবেদী, স্বামী বিবেকানন্দ, দীনেশচন্দ্র সেনের প্রয়াস ছাড়াও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রমুখের লেখায় রামায়ণের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে।
রামায়ণ পর্যালোচনায় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে যে
মূল্যায়ন করেছিলেন সেখানেও উনিশ শতকেরই উত্তরাধিকার নজরে পড়ে।
বন প্রান্তর আশ্রম জনপদ গুহা নদী সমুদ্র নিয়ে রামায়ণের বর্ণনা এক
মহাকালের যাত্রাপথ। এ সব যাত্রাপথের বর্ণনায় যখন পাওয়া যায় সমসাময়িক বাস্তবতা,
কাব্যের কল্পজগৎ ফিকে হয়ে আসে। বাল্মীকির বর্ণনায় আছে শাশ্বত জীবন আর সমাজ।
ভারত ভূখণ্ডের এক আদিকালের পর্যটন এই রামায়ণী কাব্যগাথায়, যেখানে আছে বিশ্বাস,
অনুমান আর সময়ের কাছে সমর্পণ। আর এই খোঁজই হয়ে ওঠে মহাকাব্যের প্রাণশক্তি।
অযোধ্যা, লঙ্কা, মিথিলা; গঙ্গা, গোমতী, সরযূ, গোদাবরী নদী; চিত্রকূট পর্বত— এমন কত
বাস্তবভিত্তিতে গড়ে উঠেছে বাল্মীকির বর্ণনা। রামায়ণের বর্ণনায় সংঘাত ও আদানপ্রদানের
যে সূত্র তাতে প্রাচীন ভারতের সমাজধর্মের আভাস পাওয়া যায়।জীবিকাকেন্দ্রিক যে
বিভাজন সে সময়ের কাব্যে আছে, সে সব ঐতিহ্য নিঃসন্দেহে ভারতীয় পরম্পরারই সাক্ষ্য
বহন করে। অনেক পন্ডিতই মনে করেন প্রথম স্তরে বাল্মীকি রামায়ণ রচনা আরম্ভ হয়েছিল
অতিসুসংবদ্ধভাবে।রাম যে অবতার কিংবা ভগবান তার বিন্দুমাত্র আভাস ছিল না, তিনি
নেহাতই মনুষ্য।লেখার দিক দিয়ে কোনরকম শিথিলতা কিংবা ধর্মনীতির জয়ঘোষ কোনটাই ছিল
না রামায়ণ রচনার আদিস্তরে। ঘটনার সূত্রপাত ঘটে ছিল রাজবাড়ির অন্তঃকলহে, ঈর্ষায়,
সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে, শেষ হয়েছিল রাবণ-বধে।বালকান্ডে রামরূপী বিষ্ণুর
জন্মলীলা আর উত্তরকান্ডে প্রসিদ্ধ লব-কুশ উপাখ্যানের সঙ্গে রাক্ষসরাজ রাবণ আর বানর
প্রধানদের পূর্ব জীবনের কাহিনী----এসব নাকি পরবর্তী কালের সংযোজন। আমাদের বিপদ হলো
এই যে,কালে কালে সংযোজিত রামলীলা তার বয়সও কম নয়। অর্থাৎ বহু ক্ষেত্রে এই সংযোজন
এবং প্রক্ষেপ ঘটেছে খ্রীষ্টপূর্ব সময়ে। কালিদাস কিংবা ভবভূতির মত মহাকবি
খ্রীস্টজন্মের এদিক-ওদিক সময়ের মধ্যেই তাঁদের প্রকৃষ্ট কাব্যনাটকগুলি লিখেছেন এই
প্রক্ষিপ্ত কান্ডগুলিকে অবলম্বন করেই। কাজেই কাহিনীর দিক দিয়ে অতি প্রাচীন এই
প্রক্ষেপগুলিকে, গুরুত্ব দিতেই হচ্ছে।
রাম বলতে বাল্মীকি যে অতিদেব,লোকোত্তর মানুষের স্বপ্ন দেখেনি তা
স্পষ্ট। আমার এইসব কথাবার্তা কারো কারো কাছে শুধুমাত্র আঙ্গিক-সর্বস্বতার স্বপক্ষে
ওকালতি বলে মনে হতে পারে। আসলে রামের অবক্ষয় ধর্মীয়-রাজনীতির স্বার্থে। তাই
পরিণাম ইতিহাস-ক্রমী এক প্রযুক্ত গতিময়তা।হা- "রাম" ধর্মীয় বাস্তবতাকে
ধারণ করার মতো ততখানি বীর্যবান নও তুমি।
খুব প্রাসঙ্গিক ভাবনায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে এই সম্পাদকীয়। আমার খুব ভালো লাগলো ।
ReplyDelete