আউটসাইডার
-
-এবার থেকে আর্ম-চেয়ারটা ব্যালকনিতেই রেখো! আমার মুক্ত হাওয়ার প্রয়োজন।
স্বাতী সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিল। আমার ফোন পাওয়ার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মাধবকে দিয়ে গাড়িটা হাওড়া স্টেশনে পাঠিয়ে দেয়। ট্রেন স্টেশনে ঢোকার বেশ কিছুক্ষণ আগেই আমি মোবাইলে সে খবরও পাই। নিশ্চিন্তে অনেকদিন পরে ফিরছি কোলকাতায়। স্বাতীর কাছে কিছুদিন ছুটি কাটাবার ইচ্ছে হয়েছে। কাজের চাপে কিছুতেই হয়ে উঠছিল না। শীতটা আমি কিছুতেই মিস্ করব না। সেনগুপ্তকে অনেক আগে থেকেই সে কথা বলে রেখেছিলাম। সেনগুপ্ত এ ক’দিন চালিয়ে নিতে পারবে নিশ্চয়ই। আমি কিছুদিন এক্কেবারে স্বার্থপরের মতো ছুটি কাটাব। খাব, ঘুমোব আর অনেক অনেক গল্প করব। স্বাতীর সঙ্গে। অনেক কথা জমা হয়ে আছে। তার বেশ কিছুটা ওগরাতে না পারলে কষ্ট হয়। বেশ কষ্ট! তখন মদ খাই। স্মোক্ করি! তখন আরও কষ্ট। এবার, আমাকে যেতেই হবে। স্বাতী চিঠিতে আসতে লিখেছিল। অনেকদিন তোমাকে দেখি নি, সে লিখেছিল, যদি একবার ঘুরে যাও...। সেনটেন্সটা কম্প্লিট করে নি। সে এমন ধারাই। বরাবর। সে রহস্য করতে ভালোবাসে। আমার মধ্যে সেই রহস্য দেখার একটা তাগিদ তৈরি হয়ে যায়। আরও একটা ব্যাপার আছে, স্বাতী অসাধারণ চা করে। এক্কেবারে রিয়েল দার্জিলিং টি!
স্বাতীর বালিগঞ্জের বিশাল ফ্ল্যাটটা এখন প্রায় ফাঁকাই থাকে। তার ছেলে, তথাগত, স্টেট্সে থাকে। মেয়েও বিয়ের পর বিদেশে সেট্ল করেছে। সারাদিন স্বাতী খুটুর খুটুর করে ঘরদোর পরিষ্কার করছে। বিলাস আগেও ছিল। এখনও আছে। আমাকে দেখে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। প্রতিবারই করে। স্বাতীর বাড়ি বলতে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে একটা বিশাল ফ্ল্যাট। প্রায় হাজার দুয়েক স্কয়্যারফিট। চারটে বেডরুম-হল-কিচেন। আর, মনের মতো একটা চওড়া ব্যালকনি। রাস্তার দিকে মুখ করা। সাত্যকিদা ইন্ডিয়ান অয়েলের খুব বড় কোনও পোস্টে ছিলেন। রিটায়ার করার পর এই ফ্ল্যাটটা নিয়েছিলেন। অনেক শখ করে সাজিয়েওছিলেন। বিশেষ করে ব্যালকনিটা। সাত্যকিদার সঙ্গে আমার অনেকদিনের পরিচয়। সাত্যকিদা তখন গৌহাটিতে পোস্টেড। এরকমই একটা শীতের বিকেলে গৌহাটির এয়ারপোর্টে নেমে স্বাতীকে ফোন করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি স্বাতী আর সাত্যকিদা গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে। সাত্যকিদার জুলফিটা কেমন অনেকটা ঠিক আমাদের সুনীল গাঙ্গুলীর মতো। আমি ইয়ার্কি করেই বললাম, স্বাতী তোমার নীললোহিতকেও সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছ, দেখছি। সেদিন খুব হেসেছিলাম তিনজনে। তারপর বাড়ি নয়। সোজা চলে গেলাম শিলং-য়ের দিকে।
সাত্যকিদা বললেন, চলো, একটা ভালো পাব্-এর খোঁজ পেয়েছি। তোমাকে ভালো ভদ্কা খাওয়াব। এই শীতে জমবে ভালো।
আমি বললাম, কী স্বাতী? ভদ্কা না হুইস্কি?
স্বাতী নাক বেঁকিয়ে বলল, অবশ্যই হুইস্কি।
আমি বললাম, আমিও হুইস্কি। অ্যামেরিকান।
সাত্যকিদা কী আর করে।
আচ্ছা আচ্ছা চলোই না। তারপর দেখছি।
হই হই করতে করতে আমরা চারঘন্টায় শিলং পৌঁছে গেছিলাম সেবার।
-যাও একটু ফ্রেশ হয়ে নাও। বাথরুমে তোমার টাওয়েল, রেজার সব রেখে দিয়েছি।
স্বাতীকে অনেকদিন পর দেখলাম। সে নিরুত্তাপ। কেমন ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, চা খেয়ে যাবে? না, এসে খাবে?
আমি কিছু না বলেই বাথরুমে ঢুকে গেলাম। স্বাতী আর বিলাস রান্নাঘরে।
পরের দিন সকালের দিকে একটা ফোন এল। কী করে যেন খবর পেয়ে ভাইজ্যাগ থেকে সিদ্ধার্থ করেছে।
-শোন, তোমার ওখানে ফোন করে জানলাম, তুমি কোলকাতায়। স্বাতীদির ওখানে উঠেছ। আমার এখানে একটা প্রোগ্রাম আছে। সুতরাং, তোমাদের আসতেই হবে। কিচ্ছু শুনব না।
আমি তাকে বলি, অনেকদিন পর কাল কোলকাতায় ল্যান্ড করেছি বস্। এক্ষুণি ভাইজ্যাগে যাওয়া যাবে না।
সে আমায় বলল, তুমি স্বাতীদিকে দরজাটা খুলতে বলো। একবার। দেখ, একটা ছেলে ফ্লাইটের টিকিট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
অবিশ্বাস্য! বলে কী? স্বাতীকে দরজাটা খুলতে বলি। একটা ছেলে দাঁত বের করে বলে, আমি অনিমেষ।
-বেশ হয়েছে। মালটা দাও। আর, ফোটো।
সে চলে যায়। আমি সিদ্ধার্থকে ফোন করি, এটা পাগলামি হচ্ছে না?
মোটেই না স্যর, জবাব আসে।
মুখ থেকে আলগোছেই বেরিয়ে যায়, শুয়োরের বাচ্চা। স্বাতী পাশেই ছিল। মুখটা কোঁচকাল। সিদ্ধার্থ যখন কোলকাতার মেসে থাকত, একদিন স্বাতীর এই বাড়িতেই নিয়ে এসেছিলাম। তখন সাত্যকিদা বেঁচে। মদ খেয়েছিলাম চারজনে মিলে। আড্ডা চলেছিল রাতভর। সিদ্ধার্থ আমার অনেক দিনের বন্ধু। আমার থেকে বয়সেও ছোট। তার আমার ওপর একটা জোর আছেই। কী আর করা? পরের দিনই বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে কিছুদিনের জন্য চলে এলাম দক্ষিণের শহরে। ভাইজ্যাগ। সমুদ্র। শহর। এখানে অনেক কিছুই বিখ্যাত। স্বাতী অবশ্য ঠিক রেডি ছিল না। তাকে বললাম, চল। এক সঙ্গে তো কখনও কোথাও যাই নি। খুব একটা খারাপ লাগবে না বোধহয়। সে নির্লিপ্তভাবে বলল, না না, সে ঠিক আছে।
ভাইজ্যাগে সিদ্ধার্থ আমাদের জন্য একটা কটেজ বুক করে রেখেছিল। এক্কেবারে রামকৃষ্ণ বিচের পাশেই। একটা টিলার ওপরে কটেজ। ঘরে বসে সমুদ্র দেখা যাবে। এখানেও সুন্দর একটা ব্যালকনি আছে। সেখানে দুটো ইজিচেয়ার রাখা। তারই একটাতে আমি বসলাম। সিদ্ধার্থ আসতে পারে নি। অফিসের কাজে আটকে গেছে। তবে, ফোন করেছিল। তার শ্যফার এসে আমাদের এই সমুদ্র-কুটিরে পৌঁছে দিয়ে গেছে। ভালো! স্বাতীকে দেখলাম, ব্যালকিনিতে দাঁড়িয়ে গুন গুন করে রবীন্দ্রসংগীত গাইছে। বেশ একটা চেঞ্জ চেঞ্জ লাগছে। কোলকাতায় ঠিক চেঞ্জ হয় না। সে-টা এতক্ষণে বেশ বুঝতে পারছি।
সিদ্ধার্থ এল সন্ধে সাতটার সময়ে। সঙ্গে, কয়েকজন স্থানীয় বাঙালি ছেলে। আমাকে দেখতে চায়। কেন? জিগ্যেস করলাম। সকলে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। আমি স্বাতীর দিকে তাকালাম। সে মুচকি হেসে চায়ের ব্যবস্থা করতে গেল। আমি আর সিদ্ধার্থ অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা মারলাম। কিন্তু, স্বাতী একবারও এল না। আগের মতো আমাদের জয়েনও করল না। থাক, তাকে আজ বিশ্রাম দিলাম। বোধহয়, মাথা-টাথা ধরেছে। ফ্লাইটে চড়লে আমারও মাথার ব্যামো হয়। সেরকমই কিছু একটা হবেও বা। সিদ্ধার্থ একটা জ্যাক ড্যানিয়েলের বোতল এনেছিল। সেটাই শেষ করলাম। কমবয়েসি ছেলেরা লজ্জায় খেল না। বুঝলাম। আমার বয়স হয়েছে। আমাকে শ্রদ্ধা দেখাচ্ছে। ডিনার টেবিলে স্বাতী এল। সামান্য খেল। ভাত-মাছ। কথা বলল না একটাও। শুধু বলল, ভীষন টায়ার্ড। ভাজা পমফ্রেট খেতে খেতে আমি তাকে ঘুমিয়ে পড়তে বললাম। সে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল। আমি অনেক রাত পর্যন্ত ব্যালকনিতে গিয়ে সমুদ্রের আওয়াজ শুনলাম। ধূমপান করলাম। একটা কবিতা লিখব বলে ভাবলামও। কিন্তু, লিখলাম না। একটু চোখ লেগে গেছিল। অনেক রাতে চোখ খুললে দেখলাম, সমুদ্রে ট্রলারের আলো ঝিক্মিক্ করছে। বেশ লাগছিল বে অব্ বেঙ্গল। এক্কেবারে শান্ত ঢেউ। সমুদ্র মাঝরাতে বেশ এগিয়ে আসে। শুনেছিলাম। দেখিনি কখনও। সিদ্ধার্থ-র দৌলতে এবার দেখাও হয়ে গেল। আমি শেষরাতের দিকে বিছানায় আসি। আর, ভোরের দিকে ঘুম থেকে উঠতে পারি না। এটাই নিয়ম। এটাই রেওয়াজ। আজও বেশ বেলা করে উঠলাম। দেখলাম, স্বাতী অনেক আগেই উঠে বসে আছে। আমাকে বলল, তোমার জন্যই ওয়েট করছি। চা বলি? আমি জড়ানো গলায় বললাম, বলো।
যদিও, এই স্বাতীর বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। একদিন আমার উত্তরবঙ্গের বাড়িতে আমার নামে একটা চিঠি আসে। এখনও মনে পড়ে, খামটা ছিল সবুজ। এককোণে আমার নাম লেখা। অন্য কোণে প্রেরকের নাম, স্বাতী চ্যাটার্জী। গ্রাম+পোস্ট- মহেশডাঙা, ভায়া-রসুলপুর বর্ধমান-৭১৩১৫১। আমি এ ধরণের চিঠি প্রতিদিনই কিছু না কিছু পাই। ভালোই লাগে। পড়ি। আবার, পড়িও না। আমার যে রকম স্বভাব। তবে, স্বাতীর চিঠিটা না পড়লে ঠকতাম। জীবনে এ রকম এক মহিলার সঙ্গে দেখাও হত না কখনও। স্বাতীর চিঠিটা নিয়ে আমার লেখার টেবিলে বসলাম। বেশ ভারীই ছিল খামটা। সাবধানে ছিঁড়লাম। ভেতর থেকে একতাড়া কাগজ বেরিয়ে এল। সম্বোধনটাও খুব সুন্দর করেছিল স্বাতী।
বন্ধু,
আপনার কবিতা পড়ি আর অবাক হই। মাঝেমধ্যে, একটা অদ্ভূত আনন্দ হয়। আবার, কান্নায় ভেঙে পড়ি কখনও কখনও। কী ভীষন সাংকেতিক লেখেন আপনি! আপনার সব ক’টা কাব্যগ্রন্থই আমার পড়া হয়ে গেছে। আরও যে ক’টা লিখবেন, সেগুলোও এখন থেকেই আগাম বুক্ করে রাখলাম। শুধু, একটা কথাই বলব। অবশ্য যদি কিছু মনে না করেন, শুধু কষ্ট আর মৃত্যু নিয়েই লিখবেন না। ভালোবাসা আর যাপন নিয়েও লিখবেন নিশ্চয়ই। আমি আশা করে থাকব। কখনও বর্ধমান এলে আসবেন। যদিও, আমি কতদিন বর্ধমানে থাকব, সেটা এখনই নিশ্চিত নয়। আর, শেষ কথাটা যদি এরকম হয়, ভালো লাগবে-
সেই অদ্ভূত রাতের গল্পগুলো একদিন না একদিন
ফিরে আসবে। সেদিন কিন্তু আমাদের মধ্যে কেউ না
কেউ চলে যেতে চাইবেই। তবে, অদূরে না। অন্ধকারে না।
পথচলতি ট্রামের পেটের মধ্যে ঢুকে যেতে চাইবে
শহরের কোথাও না কোথাও। ধরে নাও, রেড রোড
থেকে যে রাস্তাটা কোলকাতার নাড়িনক্ষত্র ধরে
আরও পশ্চিমে আরও পশ্চিমে চলে গেছে, তার কাছে।
চিঠি পড়া শেষ করে অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম। ভালো লাগছিল না। সেদিন আবার কোথাও একটা যাওয়ারও কথা ছিল। গেলাম না। সারাদিন বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করেছিলাম। লেখার তাগিদ অনুভব করেছিলাম সেদিন। তারপর, স্বাতী অনেক জায়গা ঘুরে এসে উঠল বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। এই নিয়ে বেশ কয়েকবারই আমি স্বাতীর বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে এলাম। স্বাতীর সঙ্গে ভাইজ্যাগ অবশ্য এই প্রথম। চা এসে গেছে। এদের ব্যাপার স্যাপার বেশ বিলিতি। দার্জিলিং চা। স্বাতী করে দিল। আমি আজকাল দুধ চিনি কিছুই খাই না। কিন্তু, চায়ের ফ্লেভারটা এনজয় করি। ভালো লাগে। স্বাতীকে রেডি হতে বলে আমি বাথরুমে ঢুকলাম।
সে একটা উজ্জ্বল হলুদ শাড়ি পরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ সিদ্ধার্থদের বাঙালি ক্লাবে একটা অনুষ্ঠান আছে। ওরা গাড়ি পাঠাবে বলে গেছে। সময় এখনও হয় নি।
স্বাতীকে বললাম, কেমন লাগছে?
সে স্নিগ্ধ ভাবে বলল, ঠিকঠাক।
আমি জিগ্যেস করলাম, অনেকদিন পর বেরোলে?
উত্তর এল, ঠিক তাই।
আমি কিছু পুরনো কথায় ফিরে যাই, সাত্যকিদার সঙ্গে কখনও আস নি এদিকটা?
সে স্মিত হাসে, একবার। সেবার এখানে উঠি নি। শহরের একটা হোটেলে। গাড়ি নিয়ে বিচে আসতাম।
আমি সিগারেট আগুন ধরিয়ে ফস্ করে বলে বসলাম, তফাৎটা কিছু বুঝলে এবার?
স্বাতী আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর, হঠাৎ-ই গম্ভীর হয়ে গেল। উঠে গেল চেয়ার ছেড়ে। আমি টাইমিংটা কোনও দিনই ঠিকঠাক বুঝতে পারি না। আজও পারলাম না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। অবশ্য, খুব একটা খারাপ হওয়ার সময় পেল না।
স্বাতী ঘর থেকে শালটা নিয়ে আমার কোলে ফেলে দিল, এটা নিয়ে যেও! আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম, মানে? তুমি যাবে না?
সে খুব ছোট্ট করে বলল, মাথাটা ধরেছে। আমাকে আজ বাদ দাও।
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম।
স্বাতী কাঁধে হাত রাখল, প্লিজ!
আমি চুপচাপ সিগারেট টানতে লাগলাম। যথারীতি অনুষ্ঠানে গেলাম। কিছু সময়ের জন্য স্বাতীকে ভুলে মেরে দিলাম। খেলাম দেলাম। অনেক বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েকে অহেতুক জ্ঞান দিলাম। সিদ্ধার্থর সঙ্গে আড্ডা মেরে সময়টা খুব কিছু খারাপ কাটল না। ফিরতে ফিরতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। ওদের গাড়ি আমায় আমার কটেজের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল। এবেলা সিদ্ধার্থ নিজে এসেছিল। অনেক করে বলে গেল, আবার আসতে। বললাম, আসব। নিশ্চয়ই আসব। কিন্তু, আমি নিজেও জানি, আর কোনদিনও আমার এখানে আসা হবে না। আমি নিজে বা স্বাতীকে নিয়েও আসতে পারব না কোনদিন। হঠাৎ স্বাতীর কথা মনে পড়ল। তার মাথা ধরেছিল। সে কেমন আছে? বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছিলাম স্বাতীর মাথা ধরার ঘটনাটা। ঘরে ঢুকে দেখলাম, সে নিজের বিছানায় দিব্যি শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে বসলাম। দেখলাম, সে ঘুমোচ্ছে। প্রায় ষাট ছুঁই ছঁই এক মহিলাকে এত কাছ থেকে বোধহয় প্রথম দেখলাম। দেখলাম, সে সুন্দরী। তার বলিরেখা বলে দিচ্ছে সে এখনও অনেক আঘাত সহ্য করবে। উঠে পড়লাম। কেমন দুর্বল লাগছে নিজেকে। স্বাতীর কাছে কেমন অপরাধী মনে হতে লাগল। কেন? সেটা বুঝতে পারছি না। ভালো লাগছে না। আমি সত্যিই বোধহয় স্বার্থপর। ফিরে আসি স্বার্থপরতার জন্য। চলে যাই স্বার্থপরতার জন্যই। ব্যালকনিতে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর মৃদু তন্দ্রা মতো এসে গেছিল। ঘাড়ের কাছে একটা হাত আমাকে মৃদু টোকা দিল। আমি তন্দ্রা ভেঙে ঘাড় ফেরালাম।
-কেমন হল অনুষ্ঠান?
স্বাতীর বোধহয় ব্যথাটা বেড়েছে। দেখলাম, সে কষ্ট করে হাসছে।
অপরাধীর মতো বললাম, ওই হল একরকম।
গতকাল স্বাতীর বালিগঞ্জের বাড়িতে ফিরে এসেছি। স্বাতীকে এখন সুস্থ লাগছে। আমি কিন্তু সেই ব্যালকনির ইজিচেয়ারটায় জাঁকিয়ে বসে আছি। মাধবকে দিয়ে হুইস্কি আনিয়ে নিয়েছি। দু’ লিটার। এই শেষ কয়েকদিনে মনে একটা অদ্ভূত চেঞ্জ এসেছে, বুঝতে পারছি। কিন্তু, কাউকে বোঝাতে পারছি না। তবে, আমার ফিরে যাওয়ার সময়ও প্রায় হয়ে গেল। গতকাল কোলকাতায় ফিরে আসার পরই সেনগুপ্তর ফোন এসেছিল। সে সামলাতে পারছে না। আমি বললাম, চিন্তা কোর না। আমি নির্ধারিত সময়েই ফিরব। ফিরেই যাই! আমারও কেমন যেন পোষাচ্ছে না। কিন্তু, স্বাতীর সঙ্গে একবার বসতে হবে। ব্যাপারগুলো কেমন যেন ঘোলাটে থেকে যাচ্ছে। স্বাতীকে বললেও তার সময় হচ্ছে না। আজ সন্ধেবেলা কোনও কাজ নেই। একবার দুপুরের পর শুধু কলেজ স্ট্রিট যেতে হবে, এই যা। আমি কেন যেন আর কোলকাতাকে নিজের করে নিতে পারছি না। স্বাতীকেও। সেটা বোঝান উচিত। স্বাতী হয়ত অনেক আশা করে আছে। কিন্তু, আমার পক্ষে আর তার কোনও চাহিদাই মেটানো সম্ভব না। অবশ্য, এসবই আমার মস্তিষ্কপ্রসূত। স্বাতী কোনও চাহিদাই কখনও আমায় ব্যক্ত করে নি। তাছাড়া, আমার নিজের কাজ রয়েছে। দায়িত্ব আছে। লেখার কেরিয়ারটাকেও হালকাভাবে নেওয়া উচিত হবে না। স্বাতীর সঙ্গে আজই বসব। তাকে বোঝাতে পারব কিনা, জানি না। তবে, শেষ চেষ্টা করতেই হবে।
সেই মতো, দুপুরের খাওয়ার পর তাকে বললাম, স্বাতী, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে। জরুরি। আজ রাতে আমায় একটু সময় দিও।
সে, ‘আচ্ছা’ বলে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। আমার কেমন যেন দ্বিধাগ্রস্থ লাগে। সে কি আমাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে না? বিকেলে কলেজ স্ট্রিট গিয়ে অনুপমের সঙ্গে দেখা হল। কফিহাউসে গেলাম না। একটা ছোট চায়ের দোকানে বসলাম।
- কী করছিস, অনুপম?
সে বলল, গুরু, তুমি তো কেটে পড়লে মাইরি। আমাদের অবস্থাটা বোঝ! তোমার মতো লিখতে পারলে, গুরু, জমে যেতাম। কিন্তু, কী করব, সে রকম তো পারি না। তাই, জমা পড়ে গেছি। ভালই আছি। প্রুফ ট্রুফ দেখে বেঁচে আছি কোনওমতে। তবে, লিখে যাচ্ছি। কেউ ছাপায় না। ছাপাতে বললে পয়সা চায়। বাজে কাজ হয়। পয়সা দিয়ে জীবনেও ছাপাব না বস্। ওতে সম্মান থাকে না।
অনুপমের ‘সম্মান’ কীসে থাকে আর কীসে থাকে না, ভাবতে ভাবতে ট্রামে উঠলাম। স্বাতীদের বাড়ি পৌঁছাতে প্রায় আটটা বাজল। স্বাতী পড়ার ঘরে ছিল। টেবিল-ল্যাম্পটা জ্বলছে। সামনে একটা বই খোলা। স্বাতী তন্ময়। পড়ছে। বইটা আমারই লেখা কিনা, দেখার সাহস হল না।
এইসব পাড়ায় আমাদের মতো কিছু লোক এখনও বেঁচে আছে। তাদের বয়স আমাদের মতোই হবে। এই চুল-দাড়ি-গোঁফ সবই আমাদের মতো। তারাও আমাদের মতোই ভাড়াটে। রাত করে বাড়ি ফিরে আসে। আলো জ্বলে। আলো নেভে। থকথকে থমথমে ল্যাম্পপোস্টগুলো জ্বলে ওঠে। আমি জানলার কাচে কাগজ মেরে রেখেছি। ওখান থেকে তোমাদের গতানুগতিকতা কিছুতেই দেখব না। আমি স্থির হয়ে দু’দণ্ড বসে থাকব। শুয়ে থাকব রেললাইনের আশেপাশে। আর, পাশ কাটিয়ে হুইস্ল চলে যাবে। হয় তুমি যাবে। না হয়, আমি। সময়টা আগে বা পরে হতে পারে। যাব-ই। কথাটা অস্বীকার করার কোনও মানে হয় না।
স্বাতী চুপচাপ বসে রইল। এভাবে বসে থাকলে টেবিলল্যাম্পের অপমান হয়।
বললাম, এক গ্লাস জল দেবে?
স্বাতী জল এনে দিল।
সে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, কিছু বলবে?
আমি জল খেয়ে বললাম, আজ আর কিছু বলার নেই। দেখি, কাল যদি তাড়াতাড়ি উঠতে পারি!
স্বাতী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে গেল।
তারপর, একটু গলা তুলে বলল, চা খাবে?
দ্বিধাগ্রস্তভাবে বললাম, ব্যালকনিতে পাঠিয়ে দিও।
সে রাতে কিছুই খেলাম না। মনটা ভাল লাগছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে, এটা আমার জায়গা না। সেনগুপ্ত আমাকে চায়। সে আমাকে ছাড়া একা চলতে পারে না। আমার সেখানে কিছু দায়িত্ব আছে। এখানে আমাকে কেউ চায় কিনা অথবা আমার কোনও দায়িত্ব আছে কিনা আমি বুঝতে পারছি না। সবাই নিজের নিজের কাজ করে যাচ্ছে। একমাত্র, আমি ছাড়া। কেমন জবুথবু হয়ে ব্যালকনিতে বসে আছি। উদ্বৃত্তের মতো। সময়টা মধ্যরাত। কয়েকটা মাতাল আর ট্যাক্সি ছাড়া রাস্তায় কেউ নেই। আমি ব্যালকনিতে বসে মাতালদের আচরণ দেখি। স্বাতী খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিল। মিথ্যে বললাম, খেয়ে ফিরেছি। আসলে, খাওয়ার মুড আজ একদমই নেই। স্বাতীও হয়ত খেল না। খোঁজ নিই নি। নেওয়া উচিত ছিল কিনা জানি না। তবে, দমবন্ধ শহর থেকে দ্রুত পালাতে ইচ্ছে করছে। ভাইজ্যাগ তবুও ভাল। কোলকাতায় কিচ্ছু নেই। ধুলো আর গতি। এই বয়সে আর ভাল লাগছে না। আমার সদর শহর অনেক ভাল। অনেক ইন্টিমেট, অনেক কর্ডিয়াল। কিন্তু, সেখানে স্বাতী নেই। বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটের হাতছানি নেই। না-ই বা থাকল। সাত্যকিদার কথায় ফিরে যাই। একবার আমার নাম ধরে বলেছিলেন, কেউ যদি ডাকে, যাব। না ডাকলে, কভি নেহি। আমাকে একটা প্রশ্ন ভাবাচ্ছে। কেন এলাম? কীসের লোভে? লোভ না প্রেম না দুর্বলতা – বুঝতে চাইছি। মাটি কামড়ে পড়ে যাচ্ছি। শীত শীত হাওয়ায় কখন যেন ব্যালকনিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কখন যেন হঠাৎ চমকে উঠলাম। দেখলাম, আমার মতোই একটা লোক, কাঁধে ঝোলা হাতে একটা টিনের সুটকেশ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একটা পাগল স্বাতীর বাড়ির উলটো দিকে বসে দু’হাতে আকাশ মাপছে। পাগলটা থেকে থেকেই বলে উঠছে, বাপি, বাড়ি যা! বাপি বাড়ি যা! হ্যালোজেনের আলোগুলো দপ দপ জ্বলে জ্বলে ক্লান্ত দাঁড়িয়ে আছে। আমার দু’পায়ের মাঝখানে একটা অ্যাশ্ট্রে আধপোড়া সিগারেটে সিগারেটে বোঝাই। এখানে কাছাকাছি কোনও গাছ নেই। পাখির ডাক বা পাতার শব্দ কোলকাতার লোক আর হয়তো আর কোনদিনই শুনবে না।
এইবার ফিরে যাব শাখাপ্রশাখার মাঝে।
কাজ নেই। হইচই। থেমে গেল।
ফিরে যাই এইবার। কার সঙ্গে কথা ছিল।
কার কাছে রাখা ছিল শব্দ। অক্ষর!
পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া!
রিন্ঝিন্ শব্দ শেষ হলে বুঝি দুপুর আর নেই।
এবার, কেড্সের শব্দ। স্কুল ছুটি। ঘন্টার শব্দ।
কখনও বিদ্যুতের শব্দ। ঝেঁপে বৃষ্টি আসে। বাজ পড়ে।
সকলে হই হই করে ছোটে। আমিও।
এই প্রথম বৃষ্টির মধ্যে নদীর ধারে এসে দাঁড়িয়েছি।
সঙ্গে একটি মেয়ে। সে আমায় ভালোবাসে। তাই এসেছে।
আমি, সে আর নদী।
বৃষ্টিতে ভিজছি। অতীত ভিজছে।
বর্তমান আর ভবিষ্যতও।
এরপর ঝড় উঠলে আমরা একসঙ্গে ছুটব।
অনেকদূর পর্যন্ত গিয়ে হাঁপাব। নিশ্বাস নেব।
বিকেল আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাবে।
আমরা যে যার বাড়িতে চলে যাব।
নদী একই খাতে অন্ধকারময় বয়ে যাবে।
আমরা কাল বিকেলেও এখানে আসব বলে…
বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে স্বাতী সোয়েটার বের করে দিল। একবার বললও, আর ক’দিন থাকলে কী হত?
বললাম, ওদিকে সব গোলমাল হচ্ছে। আমি না গেলে ভীষন বিপদ।
সে স্বাভাবিকভাবেই খোঁচা দিল, পালাচ্ছ?
আমিও এখন বেশ স্বাভাবিক, হয়ত তাই।
স্বাতী হাসতে হাসতে আবার খোঁচা দিল, পালিয়ে যাবে কোথায়?
আমি আর সাবলীল হাসতে পারলাম না।
বললাম, আর এখানে আসতে ভালো লাগে না। সাত্যকিদার কথা কাল রাতে খুব মনে হয়েছে। আমি যতবারই তোমায় ভেবেছি, উনি সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। সাত্যকিদা অত্যন্ত ভাগ্যবান। আমি চাইলেও তাঁর থেকে তোমায় ভিন্ন করতে পারব না। আর, সেটা আমি করবও না। যাইহোক, তুমি ভাল থাক। মাঝেসাঝে দু’চারটে চিঠি দিও। কবিতা পড়ো। আর, হ্যাঁ, পারলে কিছু লিখো-ও। আমার আর কিচ্ছু করার ক্ষমতা নেই স্বাতী। আমি বেশ রিয়ালাইজ করছি, আমি শেষ। তুমি ভাল থেকো।
স্বাতী আঁচলটুকু মুখের সামনে টানল শুধু। এর বেশি আর কিছুই লক্ষ্য করার স্পর্ধা দেখাই নি।
গাড়ি হাওড়া স্টেশনে ঢুকতেই তুমুল বৃষ্টি এল। শীতকালের বৃষ্টি! ঠাণ্ডায় কাঁপুনি দিচ্ছে। ওদিকে, ট্রেন লাগিয়ে দিয়েছে। ভিজে জবজবে রিজার্ভেশন চার্টও। বৃষ্টির হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে কোনও মতে পরাজিতের মতো নিজের সিটে বসলাম। সময় মতো ট্রেন ছাড়ল। মাধব প্ল্যাটফর্ম থেকে হাত নাড়ল। আমি অন্যমনস্কভাবে হাত নাড়লাম। একটা কথাই বারবার মনে হতে লাগল, নদী নিজের জায়গা থেকে একচুলও নড়ে নি। কিন্তু, আমি তো কাল বিকেলে নদীর পাড়ে যাওয়ার জন্য কাউকে কথা দিই নি?
ট্রেন চলছে। কখনও জোরে। কখনও ধীরে। কখনও থেমেও যাচ্ছে আচমকা। অনেকগুলো ছোট-বড় নদী দেখতে দেখতে চললাম। অনেক সবুজ দেখলাম। দেখার আর শেষ হয় না। আলো অন্ধকার সব দেখলাম। মেঘলা আকাশ পরিষ্কার হল। আবার মেঘ করল। বিকেল হল। সন্ধে হল। রাত হল। সকাল হল। আমার গন্তব্যে পৌঁছোবার আগে ট্রেন আউটারে দাঁড়াল। ফিরে তাকালাম। এখান থেকে কোলকাতা অনেক দূর। পেছনদিকে তাকালে কফিহাউস, কলেজ স্ট্রিট, বালিগঞ্জ, পার্ক স্ট্রিট, ভিক্টোরিয়া - কিচ্ছু দেখা যায় না। স্বাতী, মাধব, বিলাস, অনুপম, সিদ্ধার্থ – কাউকেই খুঁজে পাচ্ছি না। ব্যালকনিতে ফেলে যাওয়া সাত্যকিদার আর্মচেয়ার বা স্বাতীর ব্যালকনির জিনিয়া পাম – কিচ্ছু দেখা যায় না। রিয়্যালাইজ করলাম, আমি অনেকদূর চলে এসেছি। এখন আর ইচ্ছে থাকলেও স্বাতীর ব্যালকনির আর্মচেয়ারে বসা হবে না। স্বাতীর হাতের তৈরি চা-ও খাওয়া হবে না এককাপ। সাইকেল রিক্সা আর টেম্পোর হর্ন-এর মধ্যে কোলকাতাকে সাবলীলভাবে গুঁজে দিতে দিতে আমি বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যাই।
No comments:
Post a Comment